প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১১ অক্টোবর, ২০২৫
বড় অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। প্রযুক্তি আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে বিশ্বকে; কিন্তু সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যেন নিজেদেরই এক ভার্চুয়াল ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছি। তথ্যপ্রযুক্তির অভাব নেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের সরব উপস্থিতি।
তবুও কেমন যেন একটা বিশাল শূন্যতা বিরাজ করছে। সেই শূন্যতা হলো, ‘মূল বিষয়’ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা। যে দেশে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কৃষি, জেলেপেশা, শ্রম বা প্রবাস জীবনের সঙ্গে যুক্ত, সেই দেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিকমাধ্যমের প্রধান শিরোনামগুলো দখল করে আছে চটুল বিনোদন আর অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক। কে কাকে বিয়ে করল, কোন তারকার সংসার ভাঙলো, কে কোন পোশাক পরলো- এসব নিয়েই ব্যস্ত আমরা। অথচ এই দৃষ্টিভঙ্গির মারাত্মক সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য আমাদের দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তথাকথিত ডিজিটাল যুগে আমরা যেন এক প্রকার ‘ডোপামিন ড্রিভেন’ সমাজে পরিণত হয়েছি। যেখানে যে কনটেন্ট বেশি লাইক, শেয়ার বা মন্তব্য পায়, সেটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমাদের মস্তিষ্কের পুরস্কার কেন্দ্রগুলো যেন চটুল বিনোদনের পেছনেই ছুটে চলেছে, যা আমাদের ক্ষণিকের আনন্দ দিলেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না।
ডিজিটাল এই প্যারাডক্সের ভেতর থেকে আমরা বাস্তবতার থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি, একজন দিনমজুরের বাড়ির চুলায় কয়দিন পর হাঁড়ি চড়ে, একজন প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক মাসের শেষ ১০ দিন কীভাবে বাজার সামলান। এসব বিষয় এখন আমাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। আমাদের আলোচনার বাইরে থাকায় তাদের জীবনযুদ্ধও ‘ভাইরাল’ হওয়ার মতো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়। এভাবে আমরা যখন নিজেদের তৈরি করা জগতের মধ্যে আটকে আছি, তখন আমাদের মূল জনগোষ্ঠী আরও বেশি পিছিয়ে পড়ছে। তাদের সমস্যাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে, কারণ সেই সমস্যাগুলো ‘ভিউ’ বা ‘লাইক’ তৈরি করতে পারে না।
উদাহরণস্বরূপ, বর্ষার মৌসুমে দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে কম-বেশি ভয়াবহ বন্যা হয়। কিন্তু আমাদের আলোচনায় থাকে না কোন নদীর বাঁধ দুর্বল, কোথায় উদ্ধারকারী নৌকা পৌঁছাতে পারে না, কোন এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে ইত্যাদি। বরং আমরা সেসময় ব্যস্ত থাকি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কোনো বিচ্ছিন্ন খবর বা কে কাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আনফলো করল, এসব নিয়ে। এই ভুল অগ্রাধিকারের কারণে একটি শিক্ষিত জাতি হিসেবে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত এই মিথ্যা ‘ভাইরাল’ আর ‘সেনসেশনাল’ খবরের মোহ থেকে বের হতে না পারব, ততক্ষণ আমাদের দেশের উন্নয়ন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। একদিকে কৃষকের ঘর ভাসবে, অন্যদিকে প্রবাসীর বুক ভাঙবে, আর মিডিয়ার আলো থাকবে তথাকথিত ‘হাইপড’ মুখগুলোর দিকে। এই দ্বৈত বাস্তবতা আমাদের সমাজের গভীর ক্ষতগুলোকে আরও প্রকট করে তুলছে।
যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই একটি উন্নত, মানবিক ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে চাই, তবে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু বদলাতে হবে। জনপ্রিয়তা নয়, বরং প্রয়োজনীয়তাই হোক আমাদের শিরোনামের মানদ-। আমাদের ভাইরাল হতে হবে, একটি কোল্ডস্টোরেজের জরুরি প্রয়োজন নিয়ে, ভাইরাল হতে হবে একজন কৃষকের ন্যায্য দাবির পক্ষে, ভাইরাল হতে হবে একজন শ্রমিকের চিকিৎসার প্রয়োজনে, ভাইরাল হতে হবে প্রাথমিক শিক্ষকের জীবন সংগ্রামের গল্পে। যখন এসব বিষয় ভাইরাল হবে, তখনই নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ তৈরি হবে এবং বাস্তব পরিবর্তন আসবে।
দিনের পর দিন চটুল কনটেন্ট আর অর্থহীন আলোচনা দিয়ে সময় পার করলে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কেবলই একটি স্লোগান হয়েই থাকবে। বাস্তব বাংলাদেশ দিন দিন আরও পিছিয়ে পড়বে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ফেসবুকের পোস্ট দিয়ে কোনো দেশ গড়ে ওঠে না; কিন্তু নাগরিকদের সঠিক সচেতনতা একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করে। আসুন, আমরা সেই ভিত্তি গঠনে অন্তত সঠিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা শুরু করি। কারণ, ভুল আলোচনায় মেতে থাকলে আসল সমস্যা কখনও সামনে আসবে না, আর সমস্যা সামনে না এলে তার সমাধানও হবে না।
লেখক : রিপোর্টার, বাংলা এডিশন