প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১২ অক্টোবর, ২০২৫
বাংলাদেশ বিশাল এক ইতিহাসের জন্ম দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। জুলাই আন্দোলনে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জনাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় যায়। এরপর থেকে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হচ্ছে ‘সংস্কার’। ছোট থেকে বড়, রাজনীতিবিদ থেকে পলিসি মেকার, সর্বোপরি দেশের আমজনতার প্রত্যেকেই সংস্কার চেয়েছেন। কিন্তু সবাই রাষ্ট্রীয় সংস্কার চেয়েছেন। অথচ ব্যক্তিগত সংস্কারের দিকে কারো নজরই নেই। যা অবশ্যই একজন নাগরিককে হতাশার জন্ম দিতে সক্ষম। সবাই রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিকে সংস্কারের কথা বলেছে, অথচ নিজের কতটুকু সংস্কার হলো, তার হিসাব কেউ কখনও করেনি।
জুলাই পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতি, কূটনীতি, রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা এসবকিছুই নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। তাছাড়া ১৫ বছরের ফ্যাসিজম থেকে মুক্ত হয়ে সবার মধ্যেই একটা সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় লক্ষ্য করা যায়। দেশকে গড়তে সকলেই প্রস্তুত। যে কোনো সময় যেকেউ রক্ত দিতে পারে! দেশের জন্য সবার সে কী দায়বদ্ধতা!
অথচ আমরা যদি কিছু বিষয় লক্ষ্য করি, দেখা যায় বাস্তবতা বিপরীত চিত্রপট আঁকে।
আইনশৃঙ্খলার কথাই ধরা যাক। সবাই যদি দেশকে এতটা ভালোবাসে, দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে, তাহলে কেন প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজির খবর আমাদের চোখে পড়ে? কেন সেই ভুক্তভোগীরা বিচার পায় না? কেন আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধীরা কিছুসময় পরেই মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়ায়? উত্তরটা সোজা, আইন নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ হয় না, হতে পারেও না! আইন সবসময় সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্তদের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে। নিম্নবিত্তদের নাগালে পৌঁছায় নি। আইন শুধু নিম্নবিত্তদের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
গ্রামের কিংবা শহরের চায়ের দোকানে যে দেশের সংস্কারের নামে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন, সেই বক্তৃতার সময়েই হয়তো গলা ভেজানোর জন্য দোকান থেকে চা আর একটা করে সিগারেট খাওয়া নিত্যনতুন নয়। আহা! সিগারেটের ধোঁয়ায় যখন আকাশ ঢেকে যায়, তখন মুখ দিয়ে পরিবেশ রক্ষা ও স্বাস্থ্যনীতি সংস্কারের কথা ভেসে আসলেও বাস্তবে তা সেখানেই মরে যায়। আমাদের সংস্কার চেতনা ঠিক এমনই। আমরা সবাই দেশপ্রেমিক, কিন্তু হাতের ময়লা রাস্তায়ই ফেলি। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার, কিন্তু নিজের কাজটা একটু তাড়াতাড়ি করাতে ফাইলের ভেতর চা-পান খরচ ঢুকিয়ে দিই। আমরা চাই নির্বাচনে স্বচ্ছতা, কিন্তু ভোটের দিন ভোট দিতে যাই না কিংবা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে নিজের ভোট বিক্রি করি। ভোটের সঙ্গে নিজের কথা বলার যোগ্যতাটাও বিক্রি করে দিই।
রাষ্ট্রের সংস্কার মানে শুধু সরকার বদল নয়, নাগরিক মনোভাবের পরিবর্তনও। কিন্তু আমাদের সংস্কার এখন ফেসবুক পোস্ট আর টকশো আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কেউ বলছে শিক্ষা খাতে সংস্কার দরকার, কেউ বলছে অর্থনীতিতে, আবার কেউ চিৎকার করছে বিচার ব্যবস্থায়। অথচ সেই শিক্ষিত সমাজই পরীক্ষায় নকল করে, ব্যবসায়ী অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করে, একটুখানি সুযোগ পেলেই রিকশাওয়ালাও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেন না, ২০ টাকার ভাড়া ১০০ টাকা নিতেও দ্বিধাবোধ করেন না! ঠিক রমজান মাসের বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ীদের মতো।
এই ভণ্ড সংস্কার চেতনার চরম উদাহরণ রাজনীতিতেও দেখা যায়। যেই দলই ক্ষমতায় আসুক, সবাই দেশকে পরিবর্তন করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এমনকি পরিবর্তন করেও, যা দেশের জন্য কল্যানকরের চেয়ে অকল্যানকরই বেশি হয়।
শুরু হয় পরিবর্তনের নামে নতুন ভাগবাটোয়ারা। কেউ পায় নতুন ঠিকাদারি, কেউ পায় নতুন পদবি। দেশের জন্য ত্যাগ নয়, এখন রাজনীতি মানে বিনিয়োগ ও মুনাফাও বটে! নাগরিকের নৈতিক সংস্কার যেন একেবারেই হারিয়ে গেছে। কেউ রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাফিক আইন মানে না, কেউ ফুটপাথে হেঁটে মোবাইল দেখায় ব্যস্ত, কেউ আবার সামান্য সুবিধার জন্য অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে। অথচ সবাই বলে সবাই মিলেই দেশটার পরিবর্তন করতে হবে হবে। কিন্তু ‘সবাই’ মানে যেন অন্য কেউ, আমি নই!
সংস্কার আসলে কোথায় দরকার? রাষ্ট্রে, নাকি আমাদের নিজেদের মধ্যে? এডাম স্মিথ তার বাজার অর্থনীতির তত্ত্বতে ‘অদৃশ্য হাত’ নামের একটা বিষয়ের ধারনা দেন। যার মানে ব্যক্তি নিজে মুনাফা অর্জনের জন্য কাজ করলেও পরোক্ষভাবে তা সমাজের বৃহৎ স্বার্থ পূরণ করে। ঠিক একই ভাবে, রাষ্ট্র আলাদা কিছু নয়। আমি, আপনি ও আমরা সবাই মিলেই রাষ্ট্র। আমরা প্রত্যেকের জায়গা থেকে নিজেদের ভেতরে সংস্কার আনতে না পারলে ১ বছর কিংবা ২ বছর নয় সারাজীবনেও সংস্কার সম্ভব নয়।
যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চাই, তাহলে শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকে, নিজের মন থেকে। কারণ রাষ্ট্রীয় সংস্কারের আগে চাই ব্যক্তিগত সংস্কার। না হলে সংস্কার সংস্কার বলে আমরা সভ্যতার অন্যতম অসভ্য মানুষে পরিণত হবো সেই সঙ্গে দেশও।
লেখক : সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়