ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নারী ও কিশোরীর অধিকার এবং মর্যাদা

জেসমিন চৌধুরী
নারী ও কিশোরীর অধিকার এবং মর্যাদা

নারী ও কিশোরীর জীবন, তাদের শিক্ষা, সামাজিক অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান- এসব ক্ষেত্রে মাসিক স্বাস্থ্য একটি মৌলিক কিন্তু প্রায়ই অবহেলিত বিষয়। বাংলাদেশে এই বিষয়টি এখনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যদিও রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকরা নানা উদ্যোগ নিয়েছেন, বাস্তবতা এখনও অনেক ক্ষেত্রে তাদের চাহিদার সঙ্গে মেলে না। মাসিক স্বাস্থ্য শুধুমাত্র একটি শারীরিক প্রক্রিয়া নয়; এটি নারীর মর্যাদা, শিক্ষা, সামাজিক এবং আর্থ-সামাজিক অধিকার এবং মানসিক সুস্থতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

মাসিককে অনেক সময় লজ্জাজনক বা আলোচনাবিরোধী বিষয় হিসেবে ধরা হয়। পরিবার, স্কুল এবং সামাজিক পরিবেশে এ বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা কম। এর ফলে কিশোরী ও নারী স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে অসুবিধার সম্মুখীন হন। যদিও বিশ্বের অনেক দেশে মাসিক স্বাস্থ্যকে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, বাংলাদেশে এখনও অনেক শিক্ষার্থী এবং মা-বোনরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সঠিক তথ্য, পণ্য ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।

২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ইউনিসেফ (UNICEF) যৌথভাবে ‘মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’ (Menstrual Hygiene Management– MHM) ধারণা চালু করে। এটি শুধু স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার দিক নয়, বরং শিক্ষা, সচেতনতা এবং সামাজিক অংশগ্রহণের সঙ্গে যুক্ত। ২০২২ সালে মানবাধিকার কাউন্সিল মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ও মানবাধিকারের মধ্যে একটি স্পষ্ট যোগসূত্র তৈরি করে। এটি স্পষ্ট করে যে, মাসিক স্বাস্থ্য শুধু শারীরিক নয়, নৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মাসিক স্বাস্থ্যকে একটি মানবাধিকারভিত্তিক বিষয়ে পরিণত করতে হলে, সঠিক তথ্য, শিক্ষা, মাসিক ব্যবহারের পণ্য, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে কোনো সামাজিক কুসংস্কার, লজ্জা বা বৈষম্য থাকবে না।

বাংলাদেশের সংবিধান নারীর অধিকার এবং সুস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ যেমন ১৯(৩), ২৭, ২৮, ২৯ লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করে, ১৫, ১৬, ১৮(১) সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করে, ১২(ঘ), ২৮, ২৯(২), ৩৮(খ) কাউকে বৈষম্য থেকে রক্ষা করে এবং ১১, ১৯(৩), ২৩, ২৩এ, ৩৭, ৬৫(৩) সমাজের কাজে সবার সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এমনকি পরিবেশ রক্ষা সম্পর্কিত ১৮এ অনুচ্ছেদও কার্যকর। এসব বিধান মাসিক স্বাস্থ্যকে একটি ন্যায্য অধিকার হিসেবে দেখতে সাহায্য করে।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়- স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, নারী ও শিশুবিষয়ক, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার- মিলে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় মাসিক পণ্যের সহজলভ্যতা, গুণগত মান এবং দাম নিশ্চিত করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গ্রামে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করে।

তবে বাস্তবে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। স্কুল, সরকারি অফিস এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে WASH (Water, Sanitation and Hygiene) সুবিধা এখনও অপর্যাপ্ত। স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম অনেক ক্ষেত্রে বেশি এবং মান নিয়ন্ত্রণও সীমিত। এই পরিস্থিতি প্রান্তিক ও দুর্গম অঞ্চলে আরও সংকটপূর্ণ। সরকারের উদ্যোগ যেমন স্যানিটারি ন্যাপকিনের কাঁচামালের ওপর কর ছাড়, স্কুলে আলাদা টয়লেট ব্যবস্থা এবং নারী শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা- এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও, অনেক সময় সুবিধা ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায় না।

মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলেরা সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এটি শুধু মেয়েদের জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজকে সচেতন করতে হবে। স্কুলের সিলেবাসে MHM বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এমনকি যারা স্কুল ত্যাগ করেছে তাদের জন্য পুনঃশিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নারীবান্ধব ইউনিট গড়ে তোলা হয়েছে, যাতে মাসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সেবা ও পণ্য সহজলভ্য হয়।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক পরিবার ও সমাজ মাসিককে লজ্জাজনক মনে করে। ফলে খোলাখুলি আলোচনা হয় না, সচেতনতা কম এবং সামাজিক কুসংস্কার বিরাজ করে। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে, যাতে মাসিককে একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজ গ্রহণ করে।

মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বা পরিচ্ছন্নতার বিষয় নয়; এটি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত, নারীর অধিকার নিশ্চিত করে এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণকে প্রভাবিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের নির্দেশিকা অনুযায়ী, মাসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন, শিক্ষা, WASH সুবিধা এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।

সরকারি নীতি অনুযায়ী স্কুল ও পাবলিক প্লেসে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েদের জন্য আলাদা ডঅঝঐ ব্লক থাকা বাধ্যতামূলক। এসব ব্লকে সাবান, পানির ব্যবস্থা এবং ময়লা ফেলার ঝুড়ি থাকা জরুরি। নারী শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্য কৌশলপত্র ২০২১ অনুযায়ী, সরকারি অফিসে WASH সুবিধা যথাযথভাবে নেই। সাবান নেই, ডাস্টবিন নেই, হাত ধোয়ার সুবিধা নেই। তবে লক্ষ্য হলো, কর্মক্ষেত্র, কারাগার, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক স্থানে MHM সুবিধা সহজলভ্য করা। স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও MHM সুবিধা সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। অর্থের অভাব কিশোরী ও নারীকে মাসিক পণ্যের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারে। তাই স্যানিটারি ন্যাপকিনকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত, যাতে ভ্যাট না নেওয়া হয় এবং এটি আরও সাশ্রয়ী হয়। কিন্তু বর্তমানে কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই। উৎপাদনকারীরা কর ছাড়ের সুবিধা কতটা ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, তার উপরই সব কিছু নির্ভর করছে। অভিযোগ আছে, সুবিধা প্রভাবশালী কোম্পানির হাতে বেশি যায়।

সঠিক মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে, নীতি বাস্তবায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, সাশ্রয়ী পণ্য সরবরাহ, মান নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি একসাথে করা জরুরি। মাসিক স্বাস্থ্যকে মর্যাদা ও ন্যায্যতার সঙ্গে সমান গুরুত্ব দিলে, বাংলাদেশ বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।

মাসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন শুধুমাত্র নারীর স্বাস্থ্য নয়, এটি শিশু ও কিশোরীর শিক্ষা, সামাজিক অংশগ্রহণ, এবং নারীর আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে যুক্ত। সরকারি নীতি, সামাজিক সচেতনতা, অবকাঠামো এবং পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করলে দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যও সহজে অর্জনযোগ্য হবে।

সার্বিকভাবে বলা যায়, মাসিক স্বাস্থ্যকে একটি মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। এটি শুধু স্বাস্থ্য বা পরিচ্ছন্নতার বিষয় নয়, বরং নারীর মর্যাদা, শিক্ষা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, এবং ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশে নীতি ও সংবিধান সবসময় এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে, তবে বাস্তবায়নে এখনও নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকার, সমাজ ও জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে প্রতিটি নারী ও কিশোরী নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও মর্যাদাপূর্ণ মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পায়।

মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা একটি নৈতিক, সামাজিক ও মানবিক চ্যালেঞ্জ। এটি শুধু স্বাস্থ্যবিষয়ক নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতারও প্রতিফলন। সামাজিক সচেতনতা, নীতি বাস্তবায়ন এবং সাশ্রয়ী পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হলে, বাংলাদেশে নারী ও কিশোরীর অধিকার ও স্বাস্থ্যের মর্যাদা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এই ক্ষেত্রে সাফল্য শুধু স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, সামাজিক উন্নয়ন এবং মানবাধিকারের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত