প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবকে আর অস্বীকার করা যায় না। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ নানা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তরুণ এবং যুব সমাজের জন্য এই মাধ্যমগুলো তথ্য, বিনোদন, যোগাযোগ এবং সামাজিক পরিচয়ের মূল উৎস। তবে আনন্দ এবং শিক্ষার এই মাধ্যম এখন এক বিপজ্জনক দ্বিমুখী তরবারি হিসেবে কাজ করছে।
একটি দিক যেমন সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে, অন্যদিকে অনেকেই অশ্লীল, অসভ্য এবং নৈতিকভাবে ক্ষতিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রায়ই অশ্লীল ভিডিও, যৌনতার প্রলুব্ধিকর ছবি এবং অবমাননাকর কনটেন্টের ছড়ানো দেখতে পাই। এসব কনটেন্ট শুধু বিনোদন নয়, বরং যুব সমাজের মানসিক ও সামাজিক বিকাশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। গবেষণা দেখায়, নিয়মিত অশ্লীল কনটেন্ট দেখা তরুণদের মানসিক স্থিতিশীলতা কমায়, যৌনতা সম্পর্কে বিভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে এবং অনৈতিক আচরণের প্রবণতা বাড়ায়। এটি তাদের পারিবারিক সম্পর্ক, শিক্ষাজীবন এবং সামাজিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রশ্ন ওঠে, এই কনটেন্ট ছড়ানো বন্ধ করতে প্রশাসন কেন নীরব? কেন আইনের পূর্ণ প্রয়োগ হয় না? বাস্তবে, প্রশাসনের নিরবতার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, আইনসঙ্গত প্রমাণ সংগ্রহ করা জটিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট দ্রুত পরিবর্তন হয়, ভিডিও ডিলিট হয়ে যায়, একাধিক ফেক অ্যাকাউন্টের আড়ালে ছড়িয়ে থাকে। ফলে তদন্ত করা এবং দোষীদের শনাক্ত করা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে যায়। অ্যাকাউন্ট বন্ধ বা কনটেন্ট মোছা হলে প্রমাণ মিলছে না, যা মামলা দায়েরকে জটিল করে।
দ্বিতীয়ত, আইনের সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ দমন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আইনের মধ্যে প্রমাণভিত্তিক শর্ত, মামলা ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘায়ু এবং বাস্তবায়নের দুর্বলতা দোষীদের উৎসাহিত করে। প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক-আর্থিক শক্তিধররা এ ধরনের কনটেন্ট ছড়ায়। ফলে প্রশাসন সরাসরি পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক হয়।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্বব্যাপী প্ল্যাটফর্ম, যার সার্ভার অনেক সময় বিদেশে থাকে। স্থানীয় প্রশাসনের জন্য সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। একটি ভিডিও বা পোস্ট সরাতে হলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আইনি নোটিশ, এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
চতুর্থত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপ। অনেক সময় পরিবার, স্কুল বা সমাজ সচেতন হয় না বা মুখে বলে না। তরুণরা স্বাধীনভাবে ডিজিটাল কনটেন্ট গ্রহণ করছে; কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করার সামাজিক কাঠামো প্রায়শই কার্যকর নয়। এটি দোষীদের উৎসাহ দেয় এবং প্রশাসনের পদক্ষেপকে পিছিয়ে রাখে।
তরুণ সমাজ এই কনটেন্টের মুখোমুখি হয়ে বিপর্যস্ত হচ্ছে। প্রায়শই তারা নৈতিক, মানসিক ও সামাজিক দিক থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে। অশ্লীল কনটেন্ট শুধু বিনোদন নয়, বরং যুব সমাজের মানসিক ও সামাজিক বিকাশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এটি তাদের আত্মসম্মান, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমন কনটেন্ট যুবসমাজকে ‘ডিজিটাল নাশক’ হিসেবে ধ্বংস করছে। তরুণরা যা দেখে, সেটিকে বাস্তব মনে করে এবং অনৈতিক আচরণ গ্রহণ করে। সামাজিক মূল্যবোধ ক্ষয় পাচ্ছে এবং পরিবারের শিক্ষার প্রভাব প্রায়শই ডিজিটাল কনটেন্টের কাছে হার মানছে।
তবে শুধু সমস্যা চিহ্নিত করলেই হবে না। সমাধান প্রয়োজন এবং তা অনেকস্তরের। প্রথমত, সচেতনতা বৃদ্ধি। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজকে যুবসমাজের ডিজিটাল সচেতনতা বাড়াতে হবে। তরুণদের শেখাতে হবে কিভাবে অশ্লীল কনটেন্ট চিনতে হবে, কীভাবে নিরাপদভাবে অনলাইনে সময় কাটাতে হবে এবং কীভাবে অপ্রয়োজনীয় কনটেন্টের বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্ব। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ সকল প্ল্যাটফর্মকে তাদের নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
অশ্লীল কনটেন্ট শনাক্ত করে তা ব্লক বা ডিলিট করার ব্যবস্থা নেওয়া, ব্যবহারকারীদের রিপোর্টের প্রতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেওয়া এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে স্থানীয় প্রতিনিধি থাকা এবং নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা এখন সময়ের দাবি।
তৃতীয়ত, আইনের সংস্কার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে আরও কার্যকর, দ্রুত তদন্তযোগ্য এবং প্রমাণসংগ্রহ সহজ করার মতোভাবে সংশোধন করা জরুরি। যেন প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে এবং দোষীরা শাস্তি পায়। আইন শুধু শাস্তি নয়, যুবসমাজকে সুরক্ষিত রাখার একটি নৈতিক কাঠামো হিসেবে কাজ করবে।
চতুর্থত, সতর্ক নাগরিক প্রতিরোধ। সাধারণ মানুষ অশ্লীল কনটেন্ট রিপোর্ট করতে পারে, ব্লক করতে পারে এবং যুবসমাজকে শিক্ষিত ও সচেতন করতে পারে। এটি সমাজের একটি সামাজিক নিরাপত্তার জাল তৈরি করে, যা আইনের অভাবে প্রশাসনের অক্ষমতাকে কিছুটা পূরণ করতে পারে।
পঞ্চমত, শিক্ষা ও মনোসংযোগ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
যুবসমাজকে শেখাতে হবে কীভাবে নিজের মানসিক ও সামাজিক বিকাশকে সুরক্ষিত রাখা যায়। শিক্ষার মাধ্যমে যুবসমাজকে প্রযুক্তিগত বিপদের মোকাবিলা করতে সক্ষম করা যায়।
বিশেষ উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, রাজধানীর কয়েকটি কলেজে সম্প্রতি দেখা গেছে, কিছু শিক্ষার্থী ফেসবুক এবং টিকটকের অশ্লীল ভিডিও দেখে মানসিকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এতে তাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে অপরাধপ্রবণতাও লক্ষ্য করা গেছে। অনলাইনে এই ধরনের কনটেন্টের বিস্তার যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করছে এবং শিক্ষার সুফলকে বিকৃত করছে।
আরেকটি দিক হলো, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রায়শই কিছু ব্যবহারকারী নিজেকে অজ্ঞাত আড়ালে রেখে ক্ষতিকর কনটেন্ট ছড়ায়। এটি প্রশাসনের জন্য তদন্তকে আরও কঠিন করে। আইনি পদক্ষেপ না নিলে, এই প্রক্রিয়ায় যুবসমাজের ধ্বংসের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পায়।
সংক্ষেপে, সোশ্যাল মিডিয়ার অশ্লীলতা শুধু একটি ব্যক্তিগত বা প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়; এটি একটি সামাজিক, নৈতিক এবং মানসিকসংকট। প্রশাসনের নিরবতা আইনের সীমাবদ্ধতা, প্রমাণের ঘাটতি এবং প্রভাবশালী কনটেন্ট নির্মাতাদের কারণে কিছুটা বোঝা যায়। তবে এর মানে এই নয় যে, আমরা শুধু অপেক্ষা করি।
পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, নাগরিক এবং প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মের যৌথ প্রচেষ্টায় যুবসমাজকে অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন, সামাজিক সচেতনতা এবং প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ একসাথে থাকলে তরুণ প্রজন্মকে ডিজিটাল যুগের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
আমাদের তরুণদের হাতে সোনালী ভবিষ্যৎ তুলে দিতে হলে এখনই সময় এসেছে- প্রশাসনকে কার্যকর করতে, আইনের সংস্কার করতে, প্ল্যাটফর্মকে দায়িত্বশীল করতে এবং সমাজকে সচেতন করতে। অপেক্ষা নয়, পদক্ষেপ নেওয়া এখনই জরুরি। যদি আমরা সময়মতো উদ্যোগ নেই, তবে এক সময় যুবসমাজের নৈতিক ও সামাজিক মান ভেঙে পড়বে, যা পুরো দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হিসেবে দেখা দেবে।
লেখক : শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ ও কলামিস্ট আমদিরপাড়া জুমারবাড়ী সাঘাটা গাইবান্ধা