প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫
যুদ্ধ- এই শব্দটি ইতিহাসজুড়ে মানুষের অনুভূতি, স্বপ্ন, ব্যথা এবং ধ্বংসের মিলনক্ষেত্র। যুগের বিবর্তণে যুদ্ধের প্রকৃতি যেমন বদলে গেছে, তেমনি তার মর্মস্পর্শী দিকগুলোকে আমরা ক্রমে ভুলে যেতে শুরু করেছি। আজকাল অনেক নেতা যুদ্ধকে কৌশল, স্ট্যাটেজি, আর পরিসংখ্যানের খাতা হিসাবে দেখে থাকেন। বুলেট ফাটল, বোমা বিস্ফোরণ, নিহত ও আহতের সংখ্যা সংবাদপত্রের শিরোনামে আসে- ‘নিহত ৪৫ জন, আহত ৮০ জন’- আমরা তা শুধু সংবাদ হিসেবে গ্রহণ করি, গা কাঁপে না, চোখে জল আসে না। অথচ সেই সংখ্যার ভেতরে আছে নাম, পরিবার, স্বপ্ন, দৈনন্দিন জীবন- একটি সম্পূর্ণ পৃথিবী। গাজা, কাশ্মীর, আফগান সীমান্ত, ইউক্রেন- সব জায়গায় একই ছবি। একজন সাধারণ মানুষ, যিনি কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক পরিকল্পনার অংশ নয়, সে হলো সেই যুদ্ধের মূল বলি। তার মৃত্যু কেবল পরিসংখ্যানে আসে, মানবিক অনুভূতিতে নয়।
গাজার পরিস্থিতি সবচেয়ে চরম উদাহরণ। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের আজ পর্যন্ত গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬৭,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। আহতের সংখ্যা ১,৬৯,৪৩০ ছাপিয়ে গেছে। এই পরিসংখ্যানে শিশু, নারী, বৃদ্ধ সবাই অন্তর্ভুক্ত। একজন শিশু, যে শান্তিপূর্ণ বাসায় জন্মেছে, স্কুলে পড়াশোনা করত, খেলাধুলা করত, তার জীবন ধ্বংস হলো এক বিস্ফোরণে। তার মৃত্যু সংবাদে লেখা হয় ‘নিহত একজন’- এতে তার পরিবার, তার গল্প, তার স্বপ্ন কোথাও প্রকাশ পায় না। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় প্রতিটি ৫০ জন শিশুর মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করেছে। হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়েছে, চিকিৎসা ব্যবস্থা ধ্বংস, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। মানুষের আর্তনাদ সংবাদপত্রের পাতায় আসে না, কেবল সংখ্যা হিসেবে। এই সংখ্যাগুলো গাজার বাস্তবতা নয়, এটি কেবল যুদ্ধবাজ নেতাদের চোখে হিসাবের খাতা। গাজার যুদ্ধ শুধু ধ্বংসই নয়, এটি মানবতার অমানবিকতা ও আন্তর্জাতিক অবহেলার প্রতীক। যুদ্ধবাজ নেতারা বলেন, ‘আমরা দেশ রক্ষা করছি, শত্রুর আগ্রাসন থামাচ্ছি।’ কিন্তু সেই যুদ্ধের বলি হয় সাধারণ মানুষ, যাদের অস্ত্র নেই, কণ্ঠস্বর কম, ক্ষমতা নেই। তাদের মৃত্যু কেবল পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে। মিডিয়া অনেক সময় তাদের মৃত্যুকে তুচ্ছ করে দেখায়, সংবাদে সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়। পশ্চিমা মিডিয়ায় ইসরায়েলি নিহতদের ছবি, গল্প, পরিচয় বেশি গুরুত্ব পায়, ফিলিস্থিনিদের কেবল পরিসংখ্যানে ধরা হয়। এই ধরনের আচরণ বিশ্বে ন্যায় ও মানবিকতার অভাবের প্রতীক।
কাশ্মীরের পরিস্থিতিও কম ভয়াবহ নয়। সীমান্তে প্রতিদিন গুলি চালানো হয়, সাধারণ মানুষ মারা যায়। নিহত কৃষক, শিক্ষক, যুবক- তাদের মৃত্যু কখনও আন্তর্জাতিক সংবাদে গুরুত্ব পায় না। আফগান সীমান্তেও একই অবস্থা। ২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর, কাবুলের আবদুল হাক্ক স্কয়ারে দুটি বিস্ফোরণ ঘটে, যা পুরো শহরকে আতঙ্কের ছায়ায় আচ্ছন্ন করে। বিস্ফোরণগুলোকে পাকিস্তান সরকার তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তির (টিটিপি) প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে বলে দাবি করে। যদিও মেহসুদ নিজে একটি অডিও বার্তায় বেঁচে থাকার ঘোষণা দেন, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১১ অক্টোবর রাতে আফগান বাহিনী পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকিগুলোতে হামলা চালায়। এই আক্রমণে পাকিস্তান ২৩ সেনা সদস্যকে হারায়, তবে পাল্টা হানায় তারা দাবি করে, ২০০ তালেবান এবং তাদের সহযোগী সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। আফগান বাহিনী ঘোষণা করে, তারা সীমান্তে ২৫টি পাকিস্তানি চৌকি দখল করেছে। এর পরপরই তোরখাম, চামান এবং অন্যান্য প্রধান সীমান্ত চৌকিগুলো বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে বাণিজ্য, পরিবহন এবং সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবন মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।
সেনা অভিযান, বেসামরিক মানুষ, শিশু- সবাই কেবল রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের অংশ। তাদের মৃত্যু কেবল ‘উপদ্রব’ বা ‘ক্ষয়ক্ষতি’ হিসেবে গণ্য হয়। ইউক্রেনে স্কুল ধ্বংস, শিশু মৃত্যু, অবকাঠামো ধ্বংস- সব কিছুর খবর আসে ‘২০,০০০ জন নিহত’ বা ‘৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি’ হিসেবে। মানুষ, প্রাণ, চোখ, কান- সবকিছু পরিসংখ্যানে টালমাটাল। একটি প্রাণের ব্যথা সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয় না।
এই বাস্তবতা মানুষকে স্থির, সংবেদনশীলতা হারানো এবং একধরনের নির্লিপ্ততায় ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধবাজ নেতাদের কাছে এক প্রাণ সংখ্যা মাত্র। তাদের চোখে যুদ্ধ মানে বিজয়, হিসাব মানে সাফল্য। মানবজীবনের ক্ষতি, পরিবার ধ্বংস, শিশুর মৃত্যু- সবই তাদের কাছে কৌশলগত উপাদান। রাষ্ট্রের নামে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে, কিন্তু রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ মানব জীবন নয়। তাদের সন্তান নিরাপদে থাকে, কিন্তু সাধারণ মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়। গণমাধ্যমও কখনও নিরপেক্ষ থাকে না। সাংবাদিকতার নীরবতা, সংবাদপত্রে মৃতদের নাম না থাকা, শুধুমাত্র সংখ্যা প্রদর্শন- সবই যুদ্ধকে স্বাভাবিক করে তোলে। এই পরিস্থিতিতে মানবতা পুনর্জাগরণের দায়িত্ব আমাদের উপর। প্রতিটি মৃত্যুকে সংখ্যা হিসেবে না দেখে, মানুষকে পরিচয়, গল্প, নাম দিয়ে দেখাতে হবে। মিডিয়া, সামাজিক আন্দোলন, লেখালেখি, চলচ্চিত্র- সব মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রতিটি প্রাণকে এক পৃথিবী হিসেবে বোঝাতে হবে। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদেরকে যুদ্ধের কেবল ইতিহাস নয়, মানবিক ব্যথা শেখাতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালত, মানবাধিকার সংস্থা, তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান- যুদ্ধবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের জন্য দায়দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ ও কলামিস্ট, আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা