প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির অবস্থান আজও প্রশ্নবিদ্ধ। বিরোধী দলের মুখোশ পরে তারা বারবার ক্ষমতার সঙ্গী হয়েছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনে জাপার নীরব সমর্থন ও সহযোগিতা তাদের ‘আপার জাপা’ উপাধিতে পরিণত করেছে- এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুবিধাবাদীদের অবস্থান সবসময়ই তুঙ্গে ছিল। ক্ষমতার পালাবদল, জোট, ভাঙন কিংবা নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ সবকিছু মিলিয়ে গত কয়েক দশক যেন এক দীর্ঘ নাটকীয় অধ্যায়। এই নাটকে সবচেয়ে আলোচিত দুটি নাম- আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি (জাপা)। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনকালে যখনই অন্যায়, অনিয়ম, দমন-পীড়ন বা স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই জাতীয় পার্টির ভূমিকা ছিল নীরব সঙ্গীর মতো। তারা সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা ‘অভিনয়’ করলেও বাস্তবে ছিল সরকারের সহযোগী। বিরোধী দলের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতার সব সুবিধা ভোগ করাই যেন হয়ে উঠেছিল তাদের রাজনীতির মূলনীতি। ফলে সাধারণ মানুষের চোখে জাপা আজ ‘আপার জাপা’র অর্থাৎ শেখ হাসিনার আশীর্বাদে টিকে থাকা একটি দল।
জাতীয় পার্টির জন্মই হয়েছিল এক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাত ধরে। এরশাদের পতনের পর দলটি টিকে থাকার জন্য নানা কৌশল নিয়ে ছিল। আঁতাত করে বিরোধী দলে হলেও কখনও প্রকৃত বিরোধী শক্তি হতে পারেনি। বরং বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলগুলোর ছায়াতলে থেকেই সুবিধা নিয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ভোটারবিহীন এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, আন্তর্জাতিক মহলও সমালোচনায় মুখর ছিল। তখন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বৈধতা দিতে এগিয়ে আসে জাপা। প্রথমে তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও, পরে অংশগ্রহণ করে সরকারকে নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় বসার সুযোগ করে দেয়।
একই দৃশ্যপট দেখা যায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে ভোটার কেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই ব্যালট বাক্স পূর্ণ হয়ে যায়। ‘রাতের ভোটে দিনের ফল’ নির্ধারিত হয়। সেই প্রহসনের নির্বাচনকে বৈধতা দিতে আবারও জাপা সামনে আসে। তারা সংসদে বিরোধী দল, আবার মন্ত্রিসভায়ও সহযোগী এমন কৌতুকপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল।
জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ ধারণাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। দলটি বিরোধীতাকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতার দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে। সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য না দিয়ে বরং ক্ষমতাসীন দলের প্রশংসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করাই তাদের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এই প্রবণতা শুধু আওয়ামী লীগ আমলে নয়, অতীতেও দেখা গেছে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও জাপা ছিল তাদের সহযোগী। অর্থাৎ জাতীয় পার্টি একধরনের ‘সুবিধাভোগী রাজনীতির’ প্রতীক, যারা যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের পাশে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখে। এই রাজনীতি জনগণের স্বার্থে নয়, বরং কৌশলগত বেঁচে থাকার রাজনীতি। ফলে তারা প্রকৃত বিরোধী রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে হয়ে উঠেছে ক্ষমতার ‘অভ্যন্তরীণ অংশীদার’। এই দ্বিমুখী রাজনীতি গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের আস্থার জায়গাটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে দৃশ্যপট অপরিবর্তিত। জাপা তখনও আওয়ামী লীগের সহযোগী। তারা বলেছিল ‘গণতন্ত্র রক্ষায় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে’, কিন্তু বাস্তবে তারা অংশ নেয় আওয়ামী লীগের বৈধতা রক্ষায়। যখন সাধারণ মানুষ পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে, তখন জাপা বরং সরকারের পক্ষেই দাঁড়িয়েছে।
সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা গুম-খুনের মতো গুরুতর অভিযোগেও তারা নীরব থেকেছে। ব্যাংক লুট, ঋণখেলাপি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, প্রশাসনের দলীয়করণ কোনো বিষয়ে জাপার প্রতিবাদ শোনা যায়নি। ফলে অনেকের মতে, আওয়ামী লীগের যত অপকর্ম, তার অন্তত অর্ধেক দায়ভার জাপারও বহন করা উচিত।
জাপার এই দ্বিমুখী রাজনীতি জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করেছে। বিরোধী দলের দায়িত্ব হলো জনগণের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা; কিন্তু তারা তা না করে বরং ক্ষমতার আশ্রয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়েছে। এভাবেই তারা রূপ নিয়েছে এক ‘গৃহপালিত বিরোধীদলে’। যাদের অস্তিত্বের মানে কেবল শাসকের স্বার্থ রক্ষা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়েও জাতীয় পার্টি আবারও সুবিধাজনক অবস্থানেই রয়েছে। যেখানে ক্ষুদ্র দল বা আন্দোলনের কর্মীরা গ্রেপ্তার বা হামলার শিকার হচ্ছে, সেখানে জাপা নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক মাঠে বিচরণ করছে। এমনকি শেখ হাসিনার অপকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী নেতাদের, যেমন ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনাতেও প্রশাসন যে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে, তাতে বোঝা যায় জাপা এখনও ‘সরকারি দল’ হিসেবেই লালিত-পালিত। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের রাজনীতিতে জাপার ভূমিকা তাই নতুন করে প্রশ্নের মুখে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, প্রশাসনের পুনর্গঠন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় জাপা যে নির্লিপ্ত, তা তাদের রাজনৈতিক দর্শনের দেউলিয়াত্বকেই স্পষ্ট করেছে। তারা এখনও সেই পুরোনো হিসাব-নিকাশেই ব্যস্ত- কোনো পক্ষের সঙ্গে থাকলে তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকবে। এই অবস্থানই প্রমাণ করে, জাপা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়, বরং ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় টিকে থাকতে চায়। রাজনৈতিক নীতি, আদর্শ বা জনমুখী অবস্থান কিছুই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা আজও ক্ষমতার কক্ষপথে যেন ঘূর্ণায়মান এক ‘উপগ্রহ’। আর সেই ঘূর্ণনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ক্ষমতার স্বার্থ। বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের পর মানুষ চায় সুষ্ঠু নির্বাচন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব এসব পুনর্গঠন করা। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায়ও জাপার মতো দলগুলো তাদের পুরোনো সুবিধাবাদী চরিত্র ধরে রেখেছে। তাই, শেখ হাসিনা ও তার দলের মতোই জাপাকেও তাদের প্রাপ্য রাজনৈতিক ও নৈতিক বিচার পেতে হবে। কারণ, কোনো স্বৈরাচার একা টিকে থাকতে পারে না তার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন এমন সহযোগী যারা অন্যায়ের অংশীদার হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিটি অন্যায়ের সাক্ষী ও অংশীদার হিসেবে জাতীয় পার্টি তাই ইতিহাসে এক ‘সহযোগী অপরাধী’ হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার শাসনকাল এক কালো অধ্যায় যেখানে গণতন্ত্র বন্দি ছিল, মানুষ ভয়ে নিস্তব্ধ, আর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য