প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৫ নভেম্বর, ২০২৫
রাতের আঁধার চিরে আকাশে উঠে যাচ্ছে লেলিহান শিখা। বাতাসের বুক চিরে ভেসে আসছে আর্তনাদ, ফায়ার সার্ভিসের সাইরেনের শব্দ আর সর্বস্বান্ত মানুষের হাহাকার। কখনও কোনো জনবহুল বস্তি, কখনো ব্যস্ততম বাজার, আবার কখনওবা তথাকথিত আধুনিক বহুতল ভবন। দিন দিন দৃশ্যপট বদলায়, কিন্তু আগুনের বিধ্বংসী চরিত্র বদলায় না। পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজার, আরমানিটোলা থেকে শুরু করে বনানীর এফআর টাওয়ার, গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেট, বঙ্গবাজার, কিংবা সাম্প্রতিকতম কোনো বহুতল ভবনের ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে তালিকাটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রতিটি ভয়াবহ ঘটনার পর আমরা আঁতকে উঠি, শোক প্রকাশ করি এবং তারপর একসময় ভুলে যাই, ঠিক পরবর্তী আগুনের অ্যালার্ম বাজার আগ পর্যন্ত।
গত অক্টোবর মাসটিই যেন অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার এক জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে উঠেছে। মাসের মাঝামাঝি, অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর, ঢাকার মিরপুরে একটি গার্মেন্টস কারখানা ও রাসায়নিক গুদামের সম্মিলিত আগুনে বিষাক্ত ধোঁয়া ও গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে অন্তত ১৬ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এই ঘটনার রেশ না কাটতেই, ১৮ অক্টোবর দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান প্রবেশদ্বার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও রপ্তানির জন্য প্রস্তুত গার্মেন্টস পণ্যসহ কোটি কোটি টাকার মূল্যবান মালামাল ভস্মীভূত হয় এবং বহু ফ্লাইট বিলম্বিত হয়, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য এক বড় ধাক্কা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এত ঘন ঘন এই আগুনের ঘটনা? আমরা কি সত্যিই দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশ, নাকি এই প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড একেকটি কাঠামোগত দুর্বলতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি? গণমাধ্যমে এগুলোকে প্রায়শই বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ নামক নিরীহ দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কখনও কখনও এর সঙ্গে যুক্ত হয় নাশকতার মতো গূঢ় তত্ত্ব। কিন্তু, এই দুর্ঘটনা বা নাশকতার আড়ালে যে গভীর প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা, দুর্নীতি আর জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি লুকিয়ে আছে, তা আমরা দেখতে পাই কি? সময় এসেছে এই অগ্নিকাণ্ডগুলোকে কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখে, আমাদের সিস্টেমের গভীরে থাকা পচনকে উন্মোচন করার। প্রথমে ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটিকেই বিশ্লেষণ করা যাক। দুর্ঘটনা হলো এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, যা আকস্মিক এবং বহুলাংশে প্রতিরোধাতীত। কিন্তু, যখন একটি ভবনের বৈদ্যুতিক তারগুলো দশকের পর দশক ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকে, যখন একটি রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে দাহ্য পদার্থের পাশে নিয়ম ভেঙে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়, তখন সেখানে আগুন লাগলে তাকে কি স্রেফ দুর্ঘটনা বলা যায়?
বাস্তবতা হলো, আমাদের বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে যে শর্ট সার্কিট-কে দায়ী করা হয়, তা আদতে দুর্ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিনের অবহেলার একটি প্রযুক্তিগত নাম মাত্র। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ ওয়্যারিং, অনুমোদিত লোডের চেয়ে বহুগুণ বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ অভাব সবই এক একটি টাইম বোমা সেট করে রাখে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-এ অগ্নিনিরাপত্তার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কতজন ভবন মালিক তা মানেন? ফায়ার সেফটি অডিটকে একটি অপ্রয়োজনীয় বিড়ম্বনা মনে করার যে মানসিকতা, তা-ই এই দুর্ঘটনা’র ঝুঁকিকে নিশ্চিত পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। ভবন নির্মাণের সময় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, জরুরি বহির্গমন পথ, ফায়ার অ্যালার্ম এগুলো যেন কেবল নকশায় দেখানোর বিষয়। বাস্তবে, সেই জরুরি বহির্গমন পথটি হয় তালাবদ্ধ থাকে, নয়তো গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একটি অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিস যখন জানায় যে ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না, তখন সেই ঘটনাকে আর দুর্ঘটনার মোড়কে চালান করার কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকে না। এটি স্পষ্টতই প্রতিরোধযোগ্য অবহেলা।
বড় কোনো বাজারে বা বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লাগলেই নাশকতার অভিযোগ সামনে চলে আসে। এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ব্যবসায়িক শত্রুতা, ভূমি দখলের পাঁয়তারা কিংবা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা, এমন যে কোনো কিছুই এর পেছনে থাকতে পারে। প্রতিটি নাশকতার অভিযোগেরই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু, এখানে একটি সূক্ষ্ম বিপদ লুকিয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নাশকতার এই অভিযোগটি প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা এবং মালিকপক্ষের দায়কে আড়াল করার একটি সুবিধাজনক ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যখন একটি ভবনের নির্মাণেই গলদ থাকে, যখন সেটিকে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র ছাড়াই বছরের পর বছর ব্যবহার করা হয়, তখন আগুনটি শর্ট সার্কিটে লাগুক বা কেউ ষড়যন্ত্র করে লাগিয়ে দিক, ফলাফল একইরকম ভয়াবহ হয়। নাশকতার অভিযোগটি মূল সমস্যা থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে দেয়। যে ভবনটি নিজেই একটি মরণফাঁদ, সেখানে আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হলো, সেই বিতর্কের চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কেন ভবনটিকে মরণফাঁদ হতে দেওয়া হলো? নাশকতার তত্ত্ব প্রায়শই সেইসব কর্মকর্তা, ভবন মালিক এবং তদারকি সংস্থার ব্যর্থতাকে আড়াল করে, যাদের অবহেলার কারণেই একটি ছোট স্ফুলিঙ্গ মহাবিপর্যয়ে রূপ নেয়। অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ খুঁজতে গেলে আমরা একটি জটিল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার জাল দেখতে পাই। এর দায় একক নয়, বরং এটি একটি সামগ্রিক সিস্টেম ফেইলিওরের প্রতিচ্ছবি।
এর শুরু হয় ভবন নির্মাণের অনুমতি প্রদানকারী সংস্থা (যেমন, রাজউক, সিডিএ, কেডিএ) থেকে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নিয়মবহির্ভূত ভবন নির্মাণ এই বিপর্যয়ের মূল ভিত্তিপ্রস্তর। কীভাবে একটি আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন মেলে? কীভাবে অগ্নিঝুঁকি উপেক্ষা করে একটি ভবনের নকশা পাস হয়? এর পেছনে থাকা দুর্নীতি এবং অনিয়মই প্রতিটি ইটের গাঁথুনিতে ঝুঁকির বীজ বুনে দেয়। এরপর আসে তদারকির দায়িত্ব। সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যান্য পৌরসভাগুলোর দায়িত্ব হলো তাদের আওতাধীন বাজার, প্রতিষ্ঠান এবং স্থাপনাগুলো নিরাপদ কি না তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা দেখি, সরু গলিপথে, ঘিঞ্জি পরিবেশে শত শত দোকানপাট গড়ে উঠছে। জরুরি পরিস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার ন্যূনতম জায়গাটুকুও রাখা হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর নিয়মিতই বিভিন্ন ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে নোটিশ দেয়। কিন্তু, সেই নোটিশ কার্যকর করার আইনি ক্ষমতা বা সদিচ্ছা কতটুকু? ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সিলগালা করে দেওয়ার যে দৃঢ?তা প্রয়োজন, তা প্রায়শই অদৃশ্য প্রভাবের কাছে মার খায়। ফলে, নোটিশ কেবল একটি কাগুজে বাঘ হয়েই থেকে যায়।
সবচেয়ে ভয়াবহ হলো আমাদের নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা। দ্রুত নগরায়ণের চাপে আমরা জলাশয়, পুকুর, খালবিল ভরাট করে ফেলছি। অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিসকে পানির জন্য মাইলের পর মাইল ছুটতে হয়, যা আগুন নেভানোর গুরুত্বপূর্ণ ‘গোল্ডেন আওয়ার’ নষ্ট করে দেয়। একটি আধুনিক শহরে ফায়ার হাইড্রেন্টের যে ব্যবস্থা থাকার কথা, তা আমাদের কাছে বিলাসিতা মাত্র। সুতরাং, আগুন লাগলে তা নেভানোর চেয়ে ছড়িয়ে পড়ার সব ব্যবস্থাই আমরা পাকাপোক্ত করে রেখেছি। অগ্নিকাণ্ডের খতিয়ান কেবল পুড়ে যাওয়া স্থাপনা বা টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না। এর পেছনে থাকে লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার এক করুণ উপাখ্যান। যখন কোনো বস্তিতে আগুন লাগে, তখন পুড়ে যায় শ্রমজীবী মানুষের তিল তিল করে জমানো শেষ সম্বলটুকুও। তাদের মাথার ছাদটুকু কেড়ে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠেলে দেওয়া হয়। যখন কোনো বাজার বা মার্কেট পুড়ে ছাই হয়, তখন হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী রাতারাতি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। তাদের কর্মচারী, যারা এই আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তারাও কর্মহীন হয়ে পড়েন।
এই মানুষগুলোর ক্ষতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, মানসিকও। একটি অগ্নিকাণ্ড একজন শিক্ষার্থীকে বইখাতা ও সার্টিফিকেট পুড়িয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে দেয়, একজন বাবাকে তার পরিবারের ভরণপোষণের স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত করে। যারা আগুনে প্রিয়জন হারান, তাদের জীবনের শূন্যতা অপূরণীয়। এই মানবিক ক্ষতির দায়ভার কে নেবে? এই শ্রমজীবী মানুষগুলোই আমাদের সিস্টেমিক অবহেলার সবচেয়ে বড় শিকার। আর কত আগুন লাগলে, আর কত প্রাণ গেলে আমাদের ঘুম ভাঙবে? সময় এসেছে সত্যিটাকে স্বীকার করার। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডই একেকটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকাণ্ড, যতক্ষণ না পর্যন্ত এই অবহেলার জন্য কারো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হচ্ছে।
প্রতিটি ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন এখন একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। সেই তদন্তের রিপোর্ট কখনওই আলোর মুখ দেখে না, কিংবা দেখলেও তার সুপারিশমালা বাস্তবায়িত হয় না। এই চক্র ভাঙতে হবে। কেবল তদন্ত কমিটি নয়, আমাদের প্রয়োজন স্থায়ী সমাধান। এর জন্য প্রয়োজন বিল্ডিং কোডের কঠোর এবং আপোষহীন প্রয়োগ। ভবন নির্মাণে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাজউক বা সিটি কর্পোরেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। ফায়ার সার্ভিসকে শুধু নোটিশ দেওয়ার ক্ষমতাই নয়, বরং ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করে দেওয়ার আইনি শক্তি প্রদান করতে হবে। নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে জলাশয় সংরক্ষণ ও ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রয়োজন জবাবদিহির সংস্কৃতি। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন ভবন মালিক জানবে যে, নিয়ম না মানলেও তার কিছু হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জানবে যে, টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্র দিলেও তার চাকরি যাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এই আগুনের মিছিল থামবে না।
আল শাহারিয়া
পরিবেশবাদী লেখক, সংগঠক ও কলামিস্ট