প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৫ নভেম্বর, ২০২৫
আজকের যুগে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট আর সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আমাদের জীবন যেন অচল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম কাজ ফোন চেক করা, আর রাতে ঘুমানোর আগে শেষ কাজও ফোন দেখা। এই অভ্যাস এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে আমরা বুঝতেই পারছি না কখন আমরা ডিজিটাল জগতের আসক্ত হয়ে পড়েছি। ডিজিটাল আসক্তি এখন শুধু একটা খারাপ অভ্যাস নয়, বরং এটি আমাদের মস্তিষ্কের একটি নতুন রোগ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
ডিজিটাল আসক্তি বলতে বোঝায় ডিজিটাল ডিভাইস যেমন মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, গেমিং বা ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং নিয়ন্ত্রণহীন আকর্ষণ। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি ডিজিটাল ডিভাইস ছাড়া থাকতে পারে না, এবং এই ডিভাইসগুলো ব্যবহার না করতে পারলে উদ্বেগ, অস্থিরতা এবং মানসিক চাপ অনুভব করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিজিটাল আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। যখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক পাই, নতুন মেসেজ পাই বা গেমে জিতি, তখন আমাদের মস্তিষ্কে আনন্দ এবং সন্তুষ্টির অনুভূতি জোগায়। এই আনন্দের অনুভূতি পেতে আমরা বারবার ডিভাইসের দিকে ফিরে যাই। ডিজিটাল আসক্তির বেশ কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে। যেমন-
সময়ের হিসাব হারানো : ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে গিয়ে কখন কত সময় কেটে গেছে তার হিসাব থাকে না। মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য ফোন তুলে দুই ঘণ্টা কেটে যায়।
ঘুমের ব্যাঘাত : রাতে ঘুমানোর সময় হলেও ফোন ছাড়তে পারা যায় না। ফলে ঘুম কম হয় এবং পরদিন ক্লান্ত লাগে।
সামাজিক জীবনে প্রভাব : পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় কাটানো। সামনাসামনি কথা বলার চেয়ে মেসেজিংকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
মনোযোগের অভাব : পড়াশোনা, কাজ বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দিতে না পারা। বারবার ফোন চেক করার প্রয়োজন অনুভব করা।
শারীরিক সমস্যা : ঘাড় ব্যথা, চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা এবং হাতের আঙুলে ব্যথা হওয়া।
উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা : ফোন না পেলে বা ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া।
গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি ডিজিটাল আসক্তি আমাদের মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যক্রমে পরিবর্তন আনে। মস্তিষ্কের যে অংশ মনোযোগ, সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, সেই অংশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যেমন- স্মৃতিশক্তি কমে যায়। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম আমাদের স্মৃতিশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। আমরা সবকিছু গুগলে খুঁজি বলে নিজের মস্তিষ্ককে মনে রাখার কাজে ব্যবহার করি না। মনোযোগের স্থায়িত্ব কমে যায়।
ক্রমাগত ছোট ছোট কন্টেন্ট দেখার ফলে আমাদের মস্তিষ্ক দীর্ঘ সময় ধরে একটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে না। এটি বিশেষভাবে শিশু এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিকর। আবেগিক বিকাশে বাধাগ্রস্থ হয়। বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম তাদের সামাজিক দক্ষতা এবং আবেগিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। তারা বাস্তব জগতে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে অসুবিধা বোধ করে।
শিশু এবং কিশোররা ডিজিটাল আসক্তির সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের মস্তিষ্ক এখনও বিকশিত হচ্ছে, এবং এই সময়ে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম তাদের মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশে বাধা দেয়। অনেক শিশু এখন খেলার মাঠের চেয়ে মোবাইল গেমসে বেশি সময় কাটায়। তারা বই পড়ার চেয়ে ইউটিউব ভিডিও দেখতে বেশি আগ্রহী। এর ফলে তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাচ্ছে, সৃজনশীলতা কমে যায় এবং শারীরিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক কিশোর-কিশোরী সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের তুলনা অন্যদের সঙ্গে করে এবং হীনমন্যতায় ভোগে। তারা ভার্চুয়াল জগতে নিখুঁত জীবনযাপনের চিত্র দেখে নিজেদের অপর্যাপ্ত মনে করে, যা বিষন্নতা এবং মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ডিজিটাল আসক্তি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি আমাদের সমাজকেও প্রভাবিত করছে। পরিবারের সদস্যরা একই ঘরে থেকেও নিজ নিজ ফোনে ব্যস্ত থাকে। খাবার টেবিলে বসে একসঙ্গে খাওয়া এবং গল্প করার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলেও সবাই নিজের ফোনে ব্যস্ত থাকে। সরাসরি কথোপকথনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে যাই। এর ফলে আমাদের সম্পর্কগুলো ক্রমশ দুর্বল এবং অর্থহীন হয়ে পড়ছে। ডিজিটাল আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব যদি আমরা সচেতন হই এবং কিছু পদক্ষেপ নিই-
স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে : প্রতিদিন কতক্ষণ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করবেন তার একটি সীমা নির্ধারণ করতে হবে। ফোনের স্ক্রিন টাইম ট্র্যাকিং ফিচার ব্যবহার করে নিজের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখতে হবে : অপ্রয়োজনীয় অ্যাপের নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিলে, ফোন চেক করার প্রবণতা কমবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন সম্পূর্ণ ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন। এই সময়ে প্রকৃতিতে ঘুরতে যাওয়া, বই পড়া বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটালে মানসিক স্থিরতা ফিরবে।
ঘুমানোর আগে ফোন ব্যবহার না করা : ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে সব ডিজিটাল ডিভাইস বন্ধ করলে, ঘুমের গুণমান উন্নত হবে। বিকল্প কার্যক্রম খুঁজতে হবে যেমন- ফোন ব্যবহারের পরিবর্তে অন্য কোনো শখ বা কার্যক্রমে সময় দেওয়া। যেমন খেলাধুলা, সাঁতার, ছবি আঁকা, বাগান করা ইত্যাদি।
পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো : পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলা, একসঙ্গে খাবার খাওয়া এবং আড্ডা দেওয়া।
শিশুদের জন্য নিয়ম তৈরি করতে হবে : শিশুদের স্ক্রিন টাইম সীমিত করা এবং তাদের বয়স অনুযায়ী উপযুক্ত কন্টেন্ট দেখতে দিতে হবে। তাদের বাইরে খেলতে উৎসাহিত করা।
চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া : যদি আসক্তি খুব গভীর হয়ে যায় এবং নিজে নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন।
ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ এবং সমৃদ্ধ করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন আমরা এর আসক্ত হয়ে পড়ি, তখন এটি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ডিজিটাল আসক্তি এখন আর ছোটখাটো সমস্যা নয়, এটি আমাদের মস্তিষ্কের একটি রোগ। মনে রাখাতে হবে, আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করবো, প্রযুক্তি আমাদের নয়।
তামান্না ইসলাম
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়