প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫
যুগে যুগে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা দেখা গেছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতাদের তাদের কাজের জন্য জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হয়েছে, যেমন যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো অভিযোগের কারণে তাদের বিচার হয়েছে। এই বিচারগুলো শুধু আনুষ্ঠানিক আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং জনরোষ, বিপ্লব, বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বারাও হয়েছিল।
যুগে যুগে অনেক অনেক রাজনীতিবিদকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ফরাসি রাজনীতিবিদ আলফ্রেড ড্রেফাস- উনিশ শতকের শেষের দিকে এ সামরিক কর্মকর্তা ড্রেফাসকে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অভিযোগে বিচার করা হয়েছিল। তার বিচার এবং পরবর্তী পুনর্বিচার ফরাসি সমাজে গভীর বিভেদ সৃষ্টি করেছিল। জ্যাক রুবি এবং লি হার্ভে অসওয়াল্ড- জ্যাক রুবি এবং লি হার্ভে অসওয়াল্ড সরাসরি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তবে এরা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জ্যাক রুবি, যিনি প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যার জন্য অভিযুক্ত লি হার্ভে অসওয়াল্ডকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন, তিনিও বিচারের আওতায় এসেছিলেন। হুগো শ্যাভেজের বিচার- ভেনিজুয়েলার সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা এবং তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর জন্য বিভিন্ন সময়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। হুইন হেইন-এর বিচার- তাকে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা এবং জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য বিচার করা হয়েছিল। ওগুস্তো পিনোচেট-এর বিচার- চিলির সাবেক এই স্বৈরশাসককে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি যুদ্ধাপরাধের জন্য রাজনীতিবিদ ও সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের ব্যবস্থা করে, তাদের বিচার আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল টোকিওতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছেন। এই বিচারগুলো দুর্নীতির অভিযোগ, ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য মামলার বিবরণ দেওয়া হলো : ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার- ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (International Crimes Tribunal- ICT) বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। মতিউর রহমান নিজামী- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির (প্রধান)। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান- জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদণ্ড জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল এবং সাবেক মন্ত্রী। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক সংসদ সদস্য।
দুর্নীতির মামলা ও অন্যান্য আইনি কার্যক্রম ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার বিচার হয়েছে, বিশেষ করে ২০০৭-২০০৮ সালের সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলাকালীন। খালেদা জিয়া- সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন। তার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাসহ একাধিক মামলা দায়ের করা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি এগুলোতে দণ্ডিত হন। তারেক রহমান- বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। অর্থ পাচার এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় তিনি অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত হয়েছেন। এস কে সিনহা- বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি। তিনি অর্থ পাচারের একটি মামলায় অনুপস্থিতিতে ১১ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পান। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতির দণ্ডাদেশ। এই বিচারগুলোর ইতিহাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। তার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সময় মামলা হয়েছে। বিশেষ করে, সম্প্রতি (২০২৫ সালের জুলাই মাসে) আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাকে অনুপস্থিতিতে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এছাড়া, গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের সময়কার সহিংসতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার বিচারের রায় ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ থেকে আজ ১৭ নভেম্বর দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিও রয়েছেন যাদের দণ্ডাদেশ কোটি মানুষকে শোকাহত করেছিল। তাদের অধিকাংশই মব জাস্টিস বা অবিচারের শিকার হয়েছিলাম। যাদের বিচার এবং দণ্ডাদেশ অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল। এই বিতর্ক প্রায়শই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচার, প্রমাণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন, অথবা বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অভাব থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন সক্রেটিস- এই প্রাচীন গ্রিক দার্শনিককে এথেন্সের যুবকদের কলুষিত করা এবং ‘শহর কর্তৃক স্বীকৃত দেবতাদের’ অস্বীকার করার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
তিনি হেমলক বিষপানে মৃত্যুবরণ করেন। তার অনুসারী ও পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য মানুষ তার এই দণ্ডাদেশকে অবিচার হিসেবে দেখেছে। যীশু খ্রিস্ট-খ্রিস্টান ধর্ম মতে, যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা তার অনুসারীদের মধ্যে গভীর শোক ও বেদনার সৃষ্টি করেছিল এবং যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এই ঘটনাকে অত্যন্ত বেদনাময় হিসেবে স্মরণ করে। জোন অফ আর্ক- ফরাসি এই বীর নারীকে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তার সাহস এবং ফ্রান্সের ইতিহাসে তার অবদানের জন্য অনেকে তার মৃত্যুতে কেঁদেছিল। পরবর্তীতে ক্যাথলিক গির্জা তাকে সাধু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মহাত্মা গান্ধী- যদিও তাকে কোনো আদালত দণ্ডাদেশ দেয়নি, বরং একজন আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন, তবুও তার মৃত্যু সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে শোকাহত করেছিল। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা এবং অহিংস প্রতিবাদের প্রতীক ছিলেন। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র- তিনিও আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন।
আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এই মহান নেতার মৃত্যু বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত কোটি মানুষকে দুঃখ দিয়েছিল। এই ব্যক্তিরা তাদের জীবন, আদর্শ এবং ত্যাগের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলেছিলেন, যে কারণে তাদের দণ্ডাদেশ বা মৃত্যুতে অসংখ্য মানুষ শোকার্ত হয়েছিল। এই ব্যক্তিদের বিচারগুলো বিশ্বজুড়ে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি এবং রাজনৈতিক বা সামাজিক চাপের প্রভাব সম্পর্কে গভীর প্রশ্ন তৈরি করেছে।
‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’ বিশ্বব্যাপী একটি বহুল চর্চিত প্রবাদ বাক্য, কথাটির মর্মার্থ হলো, যখন কোনো সমাজে বিচারব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করে না বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না, তখন বিচারের আদর্শ ও পবিত্রতা গোপনে কাঁদে বা আক্ষেপ করে। এর প্রধান ব্যাখ্যা নিম্নরূপ: এটি বোঝায় যে সমাজে ন্যায়বিচার (justice) প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। যখন শক্তিশালী বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইনের ঊর্ধ্বে থাকে এবং সাধারণ মানুষ বিচার পায় না, তখন এই কথাটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য হয়। অনেক সময় বিচার প্রক্রিয়াটি লোক দেখানো বা প্রহসনে পরিণত হয়। প্রকৃত সত্য ও ন্যায়বিচার সেখানে গুরুত্ব পায় না, বরং ক্ষমতা ও প্রভাবের কাছে তা মাথা নত করে। আইন ও বিচারব্যবস্থার কিছু নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, যার ফলে অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পায় না বা নিরপরাধ ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার হয়। এই অক্ষমতাকে এখানে ‘রোদন’ বা কান্না হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
এই উক্তিটি সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের দিকেও ইঙ্গিত করে, যেখানে মানুষের মধ্যে ন্যায়বোধ ও সততার অভাব দেখা যায়। মূলত, এই কথাটির মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা ও ব্যর্থতা সম্পর্কে গভীর হতাশা ও আক্ষেপ প্রকাশ করা হয়। এটি একটি রূপক উক্তি, যা বোঝায় যে অন্যায় ও অবিচারের কারণে বিচারের মহিমা ও আদর্শ কলঙ্কিত হচ্ছে।
অবিচার বা ‘মব জাস্টিস’ থেকে বের হয়ে আসা উচিত কারণ এটি একটি বেআইনি ও সহিংস প্রক্রিয়া, যা গুজব ও ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ঘটে এবং প্রায়শই নিরপরাধ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ধরনের বিচার আইন, বিচারিক প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারকে উপেক্ষা করে, যার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে এবং নির্দোষ মানুষের জীবন ধ্বংস হতে পারে। এটি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং আইনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বাড়িয়ে তোলে।
বিচারব্যবস্থা কখনও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে, আবার কখনও ‘বিচারের নামে প্রহসনে’ পরিণত হয়, কারণ এটি বিভিন্ন মানবিক ত্রুটি, পদ্ধতিগত দুর্বলতা এবং বাহ্যিক প্রভাবকের শিকার। যখন আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়, তখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু যখন এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, তখন অবিচারের ঘটনা ঘটে।
তবে পৃথিবীকে সুন্দর রাখার জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদাহরণ হিসেবে সচেতন করার জন্য, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে ন্যায় বিচার হওয়া উচিত, কারণ এটি মানবিক, নৈতিক এবং আইনি মানদ-ের জন্য অপরিহার্য। প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার। হত্যাকাণ্ডের বিচার এই মৌলিক অধিকার এবং মানবতার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখে। সুতরাং, শুধুমাত্র ভুক্তভোগীর প্রতি সংহতি প্রকাশ বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার জন্যই নয়, বরং একটি ন্যায়সঙ্গত, নিরাপদ এবং মানবিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য ন্যায়বিচার হওয়া অত্যাবশ্যক।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক