ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শীত ও মানসিক অসুস্থতা : রোগী পরিচর্যায় বিশেষ সতর্কতার আহ্বান

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
শীত ও মানসিক অসুস্থতা : রোগী পরিচর্যায় বিশেষ সতর্কতার আহ্বান

ঋতুর পরিবর্তন মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে বিশেষ করে শীতকাল কিছু মানুষের জন্য শারীরিক এবং মানসিক চ্যালেঞ্জের সময় হয়ে ওঠে। শীতকাল অনেকের প্রিয় ঋতু হলেও এটি স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে আসে। শীতকালে আর্দ্রতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং অন্যান্য অণুজীবের বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, হজমজনিত সমস্যা, হাড় ও জয়েন্টের ব্যথা এবং অন্যান্য অসুবিধার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

শীতকালে শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োজন, যা প্রায়ই পুষ্টি ও শক্তির ঘাটতি তৈরি করে। এই ঘাটতি থেকে সর্দি-কাশি, হজমজনিত সমস্যা, ক্লান্তি এবং বিভিন্ন সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। শীতকালে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় সাধারণ ঠান্ডা, ফ্লু বা নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে বৃদ্ধবৃদ্ধা, শিশু ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য শীতকাল আরও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই শীতকালে সঠিক পরিচর্যা ও সচেতনতা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য একটি দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত সমস্যা। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ১৮.৭০ শতাংশ এবং শিশুদের প্রায় ১২.৬০ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। দেশের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার পরিসর সীমিত এবং প্রায় ৯১ শতাংশ মানসিক রোগী চিকিৎসা সেবা পান না। নারীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের একজন এবং পুরুষদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা সংক্রান্ত নেতিবাচক সামাজিক সংস্কার বেশি প্রচলিত। কিশোরদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার হার মাত্র দুই শতাংশেরও কম।

বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ মানসিক সমস্যার কারণে মারা যান এবং ৯৭ কোটি মানুষ মানসিক অসুস্থতা বা মাদক ব্যবহারজনিত সমস্যায় ভুগছেন। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারণ এবং পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

মানসিক অসুস্থতার কারণ বহুমুখী। জেনেটিক প্রভাব, শারীরিক ব্যাধি, মাদকাসক্তি, মস্তিষ্কে আঘাত, হঠাৎ ভয়, দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ, অতিরিক্ত আনন্দ বা দুঃখ, পরিবেশগত প্রভাব এবং নিদ্রাহীনতা সবই মানসিক রোগের সম্ভাবনাকে বাড়ায়। অনেক সময় এই কারণগুলো একত্রিত হয়ে সমস্যা আরও জটিল করে তোলে। একজন মানুষ মৃদু বা তীব্র মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ প্রায়ই সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ পায়। মৃদু মানসিক রোগ যেমন হালকা বিষণ্ণতা বা অল্পমাত্রার উদ্বেগ সহজে ধরা পড়ে না। তবে দৈনন্দিন আচরণে পরিবর্তন, ব্যক্তিগত পরিচর্যায় অবহেলা, অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা বা সামাজিক ও আর্থিক কর্মকাণ্ডে অনিয়ম দেখা দিলে সতর্ক হওয়া উচিত। যদি এই লক্ষণ দুই-তিন দিনের জন্য থাকে, অন্যরা তা উপেক্ষা করতে পারে। তবে যদি এটি দুই মাসের বেশি স্থায়ী হয়, তখন এটি মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মানসিক রোগ সাধারণভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। মৃদু রোগে যেমন অ্যাংজাইটি, হালকা বিষণ্ণতা বা নিদ্রার সমস্যা দেখা যায়, যা রোগীর দৈনন্দিন জীবনকে খুব বেশি প্রভাবিত করে না। তীব্র মানসিক রোগে রোগীর জ্ঞান বা চিন্তাশক্তি প্রভাবিত হয় এবং আচরণ হঠাৎ রুক্ষ বা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। এমন অবস্থায় কখনও ভাঙচুরের প্রবণতাও দেখা দেয়। অনেক অভিভাবক রোগীকে এমন অবস্থায় শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখেন, যা একেবারেই অযৌক্তিক এবং রোগীর উন্নয়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

মানসিক রোগ বোঝার জন্য সাধারণভাবে দুটি বড় শ্রেণি ব্যবহার করা হয়, নিউরোসিস এবং সাইকোসিস। নিউরোসিস হলো মৃদু ধরনের মানসিক অসুস্থতা, যা সমাজের জন্য তেমন হুমকিপূর্ণ নয়। এটি ওষুধ ও সাইকোথেরাপি মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং সাধারণত বারবার ফিরে আসার প্রবণতা রাখে। এর উদাহরণ হলো দুশ্চিন্তা, অবসেশন এবং ফোবিয়া। সাইকোসিস তুলনামূলকভাবে জটিল মানসিক রোগ, যা কম সংখ্যক মানুষের মধ্যে দেখা যায়। চিকিৎসা কার্যকর হলেও পুনরায় অসুস্থতার সম্ভাবনা নিউরোসিসের তুলনায় কম। বিষণ্ণতা এবং সিজোফ্রেনিয়া এর উদাহরণ।

শীতকাল মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। অনেকেই ঋতুগত বিষণ্ণতার শিকার হন, যা সাধারণত শীতকালে বেশি দেখা যায়। এই অবস্থাকে মৌসুমী বিষণ্ণতা বা সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (ঝঅউ) বলা হয়। এই সময় মানুষ হতাশ বোধ শুরু করে, মন খারাপ থাকে এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমে আগ্রহ কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে সূর্যের আলো কম থাকার কারণে মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের মাত্রা হ্রাস পায়, যা মেজাজকে প্রভাবিত করে। এছাড়া হরমোনের পরিবর্তনও বিষণ্ণতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মৌসুমী বিষণ্ণতা শুধু মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে না, শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে। এতে মানুষের ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়, ক্লান্তি দেখা দেয়, খিদে বৃদ্ধি বা হ্রাস পায় এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্বের প্রবণতা বেড়ে যায়। এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে হালকা হলেও একজন মানসিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋতুকালীন বিষণ্ণতা মোকাবিলার জন্য কিছু প্রাকৃতিক এবং কার্যকর উপায় রয়েছে। শীতকালে দিনে সূর্যের আলো গ্রহণ এবং নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি করা মেজাজকে সতেজ রাখতে সহায়ক। কাজ বা হবি দ্বারা নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে হালকা লাইট থেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে।

চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় ঔষধ এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণও করা যায়। হোমিওপ্যাথিতে নাক্স ভূমিকা, থুজা, সালফার অরাম মেট, প্লাটিনা, পালসেটিলা, স্ট্র্যামোনিয়াম, ভিরেট্রাম, ইগ্নেসিয়া, নেট্রাম মিউর, এসিড ফস, ল্যাকেসিস, চায়না, বিউফো রানা, ককুলাস ইন্ডিকা, ব্যারাইটা মিউরসহ বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে এটি সব সময় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে গ্রহণ করতে হবে। মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা কেবল ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। পারিবারিক সমর্থন, সামাজিক সচেতনতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে মানসিক অসুস্থতার প্রতি বিদ্যমান ভুল ধারণা দূর করতে হবে। রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহায়ক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের উচিত মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসা প্রাপ্তি সহজ করা।

শীতকালীন মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে স্কুল, কলেজ ও কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলাপ করা, রোগীর মনোবল বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। পাশাপাশি চিকিৎসক, মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী এবং সমাজকর্মীদের সমন্বিত উদ্যোগ মানসিক অসুস্থতা কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

উপসংহারে বলা যায়, শীতকাল শুধুমাত্র ঠান্ডা, কুয়াশা বা শারীরিক অসুবিধা নয়; এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক শান্তি এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ অপরিহার্য। শীতকালে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা মানসিক অসুস্থতা প্রতিরোধ, রোগী পরিচর্যা এবং একটি সুস্থ জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারি।

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত