প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ ডিসেম্বর, ২০২৫
দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান চিত্রটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যেটিকে একটি ‘বিধ্বস্ত’ খাত হিসাবেই আখ্যায়িত করা যায়। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নজিরবিহীন লুটপাটের ফলে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এখন ব্যাংক খাতের প্রতিটি সূচকে আঘাত হানছে। খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে, যার ফলে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিস্থিতি যে দেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য এক সতর্কবার্তা, তা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩৫.৭৭ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, ঋণ অবলোপন এবং অন্যান্য লুকানো ঋণ বিবেচনা করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। পরিস্থিতি এমন যে, ২০০৯ সালে যা ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, তা এখন এক দৈত্যাকার রূপ নিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ প্রমাণ করে, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক খাত পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও সুশাসনের চরম অভাব ছিল।
ওই পরিস্থিতির কারণেই বর্তমানে দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের ফাঁদে পড়ে কার্যত পঙ্গু হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, দুর্বল ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে এবং নতুন আমানত সংগ্রহে আস্থাহীনতার সংকটে ভুগছে। স্বাভাবিকভাবেই এই দুর্বল ব্যাংকগুলো দেশের বিনিয়োগ অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। এমনকি অবশিষ্ট সবল ব্যাংকগুলোর পুঁজিও এমন নয় যে, তারা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের বিপুল চাহিদা মেটাতে পারবে। এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদের উচ্চহার, যা নতুন বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত করছে। উল্লেখ্য, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ অবস্থা বড় বাধা সৃষ্টি করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের সামনে ব্যাংক খাতের এ সংকট হবে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তাই কঠোর ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, এর জন্য প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে চিহ্নিত করে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত বিচার করতে হবে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই চক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি, দ্রুত এই বিশাল প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে, যা ব্যাংকের আর্থিকভিত্তি মজবুত করবে। ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। এই পদক্ষেপগুলো ছাড়া নতুন সরকারের পক্ষে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করা অত্যন্ত কঠিন হবে। ব্যাংক খাতকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক কঠোরতা জরুরি। সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা।