প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ আজ এক অনস্বীকার্য সত্য; পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উচ্চশিক্ষার মতো চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রগুলোতেও নারীরা তাদের দক্ষতা প্রমাণ করে দেশের জাতীয় আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তবে বিপুল সংখ্যক নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এই সম্ভাবনার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ এবং নিরাপত্তার প্রশ্নকেও সামনে এনেছে, যেখানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও, এই অংশগ্রহণের গুণগত মান, কাজের পরিবেশ এবং নারীদের ওপর আরোপিত কাঠামোগত বাধাগুলো এখনও তাদের অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায়।
প্রথমত, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে তৈরি পোশাক শিল্প (RMG), যেখানে লাখ লাখ নারী শ্রমিক কাজ করছেন, কিন্তু এই শিল্পের বাইরে সেবা খাত, তথ্যপ্রযুক্তি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী উচ্চপদে নারীদের সংখ্যা এখনও প্রত্যাশিত নয়, যা অর্থনৈতিক বৈষম্যকেই নির্দেশ করে।
নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সত্ত্বেও, তারা প্রায়শই একই কাজের জন্য পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পাচ্ছেন, যা দেশের শ্রমবাজারে প্রচলিত ‘বেতন বৈষম্য’ নামক প্রচ্ছন্ন লিঙ্গ বৈষম্যের ফল; উপরন্তু, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর কারণে কর্মজীবী নারীদের ওপর ‘দ্বৈত কাজের বোঝা’ বা ‘ডাবল বার্ডেন’ চাপানো হয়, যেখানে তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ঘরের যাবতীয় কাজ, সন্তান ও পরিবারের পরিচর্যার দায়িত্বও এককভাবে পালন করতে বাধ্য হন, ফলে তারা কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন না এবং দ্রুত পদোন্নতি বা দীর্ঘমেয়াদি কর্মজীবন গড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
দ্বিতীয়ত, কর্মক্ষেত্রে নারীদের সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নিরাপত্তা ও হয়রানি, যেখানে গণপরিবহনে হয়রানি থেকে শুরু করে কর্মস্থলেই যৌন হয়রানি, মৌখিক নির্যাতন এবং মানসিক চাপ একটি নিয়মিত ঘটনা, যা নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং তাদের কর্মজীবন ছেড়ে দিতে বাধ্য করে, যদিও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকলেও, বেশিরভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা অনানুষ্ঠানিক খাতে এর যথাযথ বাস্তবায়ন অনুপস্থিত। উপযুক্ত শিশুযত্ন কেন্দ্রের (Daycare) অভাবও কর্মজীবী মায়েদের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ, কারণ মানসম্মত ডে-কেয়ার না থাকায় অনেক নারীকেই সন্তান জন্মদানের পর কর্মজীবন থেকে বিরতি নিতে বা স্থায়ীভাবে ইস্তফা দিতে হয়, যা দেশের শ্রমবাজারে নারীর স্থিতিশীল অংশগ্রহণকে ব্যাহত করে।
তৃতীয়ত, নারীদের উচ্চপদস্থ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ভূমিকায় (Leadership Roles) অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ‘কাঁচের সিলিং’ (Glass Ceiling) নামক অদৃশ্য বাধা এখনও বিদ্যমান, যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও নারীরা লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাতিত্বের শিকার হন এবং তাদের দক্ষতা বা দৃঢ়তার চেয়ে তাদের লিঙ্গ পরিচয়কে বড় করে দেখা হয়; অন্যদিকে, কর্মক্ষেত্রে নারী সহকর্মীদের কাছ থেকেও অনেক সময় সহযোগিতার অভাব এবং ঈর্ষামূলক আচরণ পরিলক্ষিত হয়, যা তাদের পেশাগত পরিবেশকে আরও কঠিন করে তোলে। এই সংকট উত্তরণে প্রয়োজন আইনি কাঠামো এবং সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন; কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধে আইনি নির্দেশিকা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে জেন্ডার সংবেদনশীল কমিটি গঠন করা, বেতন বৈষম্য দূর করতে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়ের জন্য বাধ্যতামূলক পিতৃত্বকালীন ছুটি (Paternity Leave) সহ নমনীয় কর্মঘণ্টা (Flexible Working Hours) নিশ্চিত করা জরুরি। সর্বোপরি, রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারের পক্ষ থেকে নারীর কর্মজীবনের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা এবং নারীকে কেবল ‘কর্মী’ হিসেবে নয়, বরং একজন ‘নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সুযোগ তৈরি করা অপরিহার্য, কারণ নারীর নিরাপদ ও পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে এবং সমাজের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জিত হবে।