প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫
শীত নামলেই বাংলার গ্রামাঞ্চলে ফিরে আসে এক চেনা দৃশ্য। কুয়াশাভেজা ভোরে খেজুর গাছের মাথায় ঝুলে থাকা হাঁড়ি, ভোরের আলো ফোটার আগেই নামানো রস, আর সেই কাঁচা রস ঘিরে মানুষের আলাদা এক আগ্রহ। বহু মানুষের কাছে কাঁচা খেজুরের রস শুধু একটি পানীয় নয়, এটি শীতের ঐতিহ্য, শৈশবের স্মৃতি আর গ্রামবাংলার সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু এই মিষ্টি ঐতিহ্যের আড়ালেই প্রতিবছর লুকিয়ে থাকে এক ভয়ংকর বাস্তবতা, যা বারবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে- অসচেতন হলে এই রসই হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুর কারণ।
বাংলাদেশে শীত এলেই নিপাহ ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভাইরাসের সঙ্গে কাঁচা খেজুরের রসের সম্পর্ক বহু বছর ধরেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বাদুড় এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক। শীতকালে খেজুরের রস সংগ্রহের সময় রাতে বাদুড় খেজুর গাছে এসে হাঁড়ির ভেতর মুখ দেয়, রসে লালা বা মল-মূত্র ফেলে যায়। সেই রস ভোরে সংগ্রহ করে কাঁচা অবস্থায় পান করলেই মানুষের শরীরে ভাইরাস প্রবেশের ঝুঁকি তৈরি হয়। এখান থেকেই শুরু হয় মারাত্মক অসুস্থতা, যার পরিণতি অনেক সময় মৃত্যু।
১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রথম মালয়েশিয়ায় নিপাহ ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। দেশে প্রথম সার্ভিলেন্স (জরিপ) শুরু হয় ২০০৬ সালে। এখন পর্যন্ত (২০০১ থেকে ২০২৫) মোট ৩৪৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। নিপাহ ভাইরাস আক্রান্তের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।
নিপাহ ভাইরাসের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো- এর উচ্চ মৃত্যুহার। নিপাহ ভাইরাস সংক্রামিত রস খাওয়ার ২ দিন পর থেকে ২৮ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দিতে পারে। শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু তার ওপর নির্ভর করে উপসর্গ দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে মস্তিষ্কে প্রদাহ, রোগের লক্ষণ খুব দ্রুত মারাত্মক রূপ নেয়। দ্রুত মস্তিষ্কে ইনফেকশন হয়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। বাংলাদেশে নিপাহ আক্রান্তদের মৃত্যু ঝুঁকি ৭০ থেকে শতভাগ পর্যন্ত দেখা যায়। এখনো পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো কার্যকর প্রতিষেধক নেই। ফলে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা মূলত উপসর্গ নির্ভর, আর সেখানেই বাড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি। শুধু তাই নয়, নিপাহ ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে, যা একটি আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঘিরে পুরো পরিবার বা সমাজের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত পাঁচজনই মারা যান। অর্থাৎ মৃত্যু শতভাগ। এর আগে ২০২৩ সালে নিপাহ ভাইরাসে ১৩ জন আক্রান্ত হন। মারা যান ১০ জন। দুঃখজনক হলেও সত্য, শীতের শুরুতেই একের পর এক মৃত্যুর খবরে দেশজুড়ে উদ্বেগ তৈরি হলেও বাস্তব জীবনে অভ্যাস বদলাতে দেখা যায়নি।
এখানে প্রশ্ন ওঠে, জানার পরও মানুষ কেন এই ঝুঁকি নিচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হলো অভ্যাস ও অবহেলা। অনেকেই মনে করেন, ‘সবাই তো খায়, আমাদের কিছু হবে না।’ আবার কেউ কেউ বিষয়টিকে গুজব বা অতিরঞ্জন হিসেবেও দেখেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নিপাহ ভাইরাস কোনো কল্পকাহিনি নয়, এটি বারবার প্রমাণিত একটি প্রাণঘাতী রোগ। সমস্যা আরও জটিল হয় যখন কাঁচা খেজুরের রস বাজারে বিক্রি হয় এবং মানুষ না জেনেই তা পান করে।
এখানে খেজুর রস সংগ্রাহকদের দায়িত্বের প্রশ্নও উঠে আসে। খুব সাধারণ কিছু ব্যবস্থা নিলেই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। যেমন, খেজুর গাছে হাঁড়ি ঢেকে রাখা, যাতে বাদুড় সহজে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু অধিক মুনাফা বা ঝামেলা এড়ানোর কারণে অনেক সময় এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে বিপদটা থেকে যায় আগের মতোই। রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর শীত মৌসুমে সতর্কবার্তা প্রচার করা হলেও তা অনেক ক্ষেত্রে শহরকেন্দ্রিক বা সীমিত পরিসরে থাকে। গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক মানুষ জানেই না কাঁচা খেজুরের রস কীভাবে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। শুধু পোস্টার বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নয়, দরকার মাঠপর্যায়ে সচেতনতা, স্থানীয় ভাষায় সরাসরি বার্তা এবং ধারাবাহিক প্রচার।
বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, খেজুরের রস পুরোপুরি বাদ দেওয়াই একমাত্র সমাধান নয়। সমস্যা মূলত কাঁচা রসে। রস যদি ভালোভাবে ফুটিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে ভাইরাস নষ্ট হয়ে যায়। পাটালি গুড় বা জ্বাল দেওয়া রস তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। অর্থাৎ সচেতন হলে ঐতিহ্যও বাঁচানো যায়, জীবনও রক্ষা করা যায়।
সবচেয়ে বড় দায়িত্ব অবশ্য আমাদের নিজের। এক গ্লাস কাঁচা খেজুরের রসের জন্য যদি জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে, তাহলে সেই স্বাদ কতটা মূল্যবান- সে প্রশ্ন আমাদেরই করতে হবে। শীতের আনন্দ মানেই যে ঝুঁকি নেওয়া, তা নয়। বরং সচেতন সিদ্ধান্তই পারে পরিবার ও সমাজকে নিরাপদ রাখতে।
প্রতিবছর শীত আসে, শীত যায়। কিন্তু প্রতিবারই যদি একই ভুলে প্রাণ ঝরে যায়, তাহলে তা আর দুর্ঘটনা থাকে না, হয়ে ওঠে অবহেলা। কাঁচা খেজুরের রস আমাদের সংস্কৃতির অংশ হতে পারে, কিন্তু জীবন তার চেয়েও বড়। ২০২৫ সালের শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই শীতে আমরা চাই ,যেন কেউ নিপাহ ভাইরাসের শিকার না হয়। প্রতিটি পরিবার যেন নিরাপদে, শান্তিতে এবং স্বস্তিতে কাটাতে পারে শীতের এই মৌসুম। আসুক ২০২৬, যেখানে শীতের কুয়াশা, খেজুরের মধুর স্বাদ এবং ভোরের আলো- সবই আনন্দের প্রতীক, কোনো আতঙ্ক বা ঝুঁকির নয়। এখনই সময় থামার, ভাবার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কারণ জীবন আছে বলেই তো শীতের আনন্দ, স্বাদের অনুভব আর আগামী দিনের স্বপ্ন।