বিগত আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকে নিরাপদ করার জন্য দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দিয়ে ভারতের কাছে স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরণ করেছিল।
তাদের কাছে দেশ, দেশের সার্বভৌমত্বের চেয়ে ক্ষমতার মূল্য বেশি ছিল। তবে জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে তীব্র জনরোষে আওয়ামী লীগের পতন হয়।
এরপরই ভারতের পাশার দান উল্টে চীন ও পাকিস্তানের উত্থান ঘটেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে এসে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। ভারত যখন আলু, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তখন পাকিস্তান ও চীন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্যের দিকে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।
গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে কনটেইনার পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। পাকিস্তানের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও কনটেইনারবোঝাই জাহাজ আসে বাংলাদেশে। পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের রাষ্ট্রপর্যায়ে সম্পর্ক রাখার চেয়ে ভারত আওয়ামী লীগের প্রতি বেশি নির্ভরশীল। তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ মনে করছে। বরং বাংলাদেশ একটি বিস্তৃত, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুমতের দেশ, যেখানে নানা রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ বাস করে। শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরতা শুধু বিপজ্জনক নয়, বরং একটি অযৌক্তিক, অলস এবং অকার্যকর পররাষ্ট্রনীতিরই উদাহরণ।
গত ৫ আগস্ট ভারতের আশির্বাদপুষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের ভিসা প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে যে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছে। এমনকি সীমান্তের কাছে এসে বিক্ষোভ করা হচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে চীনের মধ্যে একধরনের দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা ছিল। বাংলাদেশে চলমান বৃহদায়তন প্রকল্পে যুক্ত নিজের নাগরিকদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল চীন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সরাসরি বলেছেন, তাদের প্রতিবেশী কূটনীতির ‘গুরুত্বপূর্ণ স্থানে’ আছে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধা থাকবে বেইজিংয়ের। চীনের প্রতিবেশী কূটনীতিতে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাখার বিষয়টি জনসমক্ষে প্রথমবারের মতো বলেছে বেইজিং। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত না থাকার পরও বাংলাদেশের পাশাপাশি পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক কারণে এ ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ। সম্পর্কের পাঁচ দশকের ধারাবাহিকতায় চীন যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, এ ঘোষণায় তার প্রতিফলন। বাংলাদেশের নাজুক স্বাস্থ্যসেবা খাতে সহায়তায় এগিয়ে এসে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো, শিল্প স্থানান্তরের মাধ্যমে বাণিজ্য বাড়ানো এবং ঋণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছাড়ের নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়টিও স্পষ্ট।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যৎমুখী দিক থেকে বিবেচনা করলে তৌহিদ হোসেনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরটিকে ঢাকাবেইজিং সম্পর্কের অনিশ্চয়তা সরিয়ে নতুন মাত্রা যোগ বলা যেতে পারে। এ সফরে বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি চীনের রাজনৈতিক সমর্থনের জোরালো বার্তাও আছে।
অবশ্য চীন সফরের সময় চায়না মিডিয়া গ্রুপ বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতিটি সরকার চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তিনি বলেন, আমি এটুকু সফলভাবে বোঝাতে পেরেছি (চীন সরকারকে), আমাদের সরকার অন্তর্বর্তী সরকার, হয়তো দীর্ঘ সময় থাকবে না। (দুই দেশের) সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় আমরা যেসব সিদ্ধান্ত নেব, সেগুলো পরবর্তী সরকার ঠিকমতো অনুসরণ করে যাবে। সম্পর্কের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঢাকার পূর্বাচলে এক হাজার শয্যার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবকে চীন স্বাগত জানিয়েছে। চীনের অর্থায়নে দুই দেশের মধ্যে প্রথম মৈত্রী হাসপাতালটি পরিচালিত হবে চীনা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে। যেহেতু নতুন হাসপাতাল নির্মাণে কয়েক বছর লাগবে, আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও লোকজনের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কুনমিংয়ের অন্তত চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশের নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে অনুরোধ জানায় ঢাকা। প্রয়োজন হলে কুনমিংয়ের পাশাপাশি চেংদুতে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য বিশেষায়িত কিছু হাসপাতালে সেবা দেয়ার আশ্বাসও চীন দিয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশে শিল্পকারখানা স্থানান্তরের কথা বলছে চীন।
চীনের পাশপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানও সম্পর্ক জোরদারে নজর দিয়েছে। প্রায় ২০ বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে এ সভা হতে পারে। সভায় উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের পাশাপাশি যোগাযোগ বাড়ানোয় বেশি জোর দেয়া হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ইআরডির কর্মকর্তারা এরইমধ্যে জেইসি সভার আলোচ্যসূচিসহ অন্যান্য বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ জেইসি সভা হয় ২০০৫ সালে।
পাকিস্তানের সঙ্গে আসন্ন জেইসি সভার আলোচ্যসূচিতে রাখার জন্য এরই মধ্যে ১৫টি দপ্তরের প্রধানের কাছে প্রস্তাব চেয়ে চিঠি দিয়েছে ইআরডি। পররাষ্ট্র, শিল্প, বাণিজ্য, বস্ত্র ও পাট, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’কে (বিডা) চিঠি দেয়া হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে ইআরডিতে প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, জেইসির সভা করার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যে কোনো দেশের জিইসি সভার আলোচ্যসূচি ঠিক করার আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব চাওয়া হয়। পরে সেই প্রস্তাবগুলো থেকে খসড়া আলোচ্যসূচি ঠিক করে তা সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠাতে হয়। ওই দেশও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। দুই দেশের অনুমোদনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সূচি ঠিক করা হয়।
২০০৫ সালের ১২-১৩ সেপ্টেম্বর দুই দেশের মধ্যে ঢাকায় অষ্টম জেইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এখন পর্যন্ত সেটিই শেষ সভা ছিল। ওই সভায় পাকিস্তানের বাজারে শতাধিক পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা চেয়েছিল বাংলাদেশ। অন্যদিকে পাকিস্তান চেয়েছিল মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ)। আওয়ামী লীগ শাসনামলের ১৬ বছরে পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে কোনো জেইসি সভা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে এফপিসিসিআইয়ের সভাপতি আতিফ ইকরাম শেখ বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, ওষুধ, চামড়া, মেশিনারিজ, রাসায়নিক ও আইসিটি খাতে দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহজ করতে গত ছয় মাসে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন গত ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি পাকিস্তান থেকে পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। এছাড়া পাকিস্তান বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করেছে। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল চালু করা নিয়েও আলোচনা চলছে।
নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিপস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে চীনের ইতিবাচক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। চীনের সহায়তায় এ দেশের মুখ থুবড়ে পড়া স্বাস্থ্য খাতে বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। কুনমিংয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য পর্যটনের দ্বার উন্মোচনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় ভারতের ওপর নির্ভরতা কমে আসতে পারে।