ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

একুশের চেতনা বনাম বাস্তবতা

একুশের চেতনা বনাম বাস্তবতা

স্বীয় মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণচূড়ার রক্তবর্ণে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। সে দিনের সংগ্রামী তরুণদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষা ফিরে পেয়েছে প্রাণ। আমাদের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে মহিমান্বিত হয়েছে এক অধ্যায়। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষায় বাঙালি জাতিই প্রথম পৃথিবীর বুকে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছিল। ভাষার অধিকার রক্ষার আত্মদানের রক্তবীজ সূচিত হয়েছিল আরো অনেক আগে থেকেই। এই দেশের মানুষের ভাষাপ্রেম, স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ অনেক পুরোনো। বাংলাভাষার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এই ভাষার ক্রমবিকাশ বৈচিত্র্যময়। লিখিত আকারে বাংলা ভাষার গোড়াপত্তন প্রায় এক হাজার বছর আগে। তবে বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো। এই পুরোনো ভাষাকে বিনষ্ট করতে সক্রিয় হয়েছিল একটি গোষ্ঠী। তাই অন্যান্য আন্দোলনের মতো ভাষার অধিকারে মানসিকভাবে সক্রিয় হতে হয়েছিল বাঙালি জাতিকে বেশ কিছুটা সময় ধরে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত বাঙালি জাতির মানসপটে চলেছে ভাষা অধিকারের প্রচেষ্টা। বৃহত্তর ভাষাভাষী এই জনপদের মানুষ ভাষা অধিকারের সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের আত্মপরিচয়ে অধিষ্ঠিত করেছিল। আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক। যা সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকেও বাঙালি জাতিকে উদার ও একাগ্র করেছিল। বাঙালি জাতির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রতিফলিত হয়েছিল দ্বিগুণ, দারুণ দ্রোহ প্রতিশোধের আগুনে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা ছিল বাংলা। তাছাড়া সাহিত্য সংস্কৃতিতে উর্দুভাষা সীমাবদ্ধ ছিল। তারপরও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষায় মর্যাদা পেতে সংগ্রাম করতে হয়েছে অবিরাম। তরুণদের রক্তস্নান এবং বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিদীপ্ততায় আমরা অর্জন করেছি আমাদের অধিকার।

ভাষা প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রাম রচিত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই। রংপুরে প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে ১৯১১ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী বাংলা ভাষাকে ভারতের অন্যতম ভাষা হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতির আহ্বান করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্? ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতী সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। মওলানা আকরম খাঁ ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করায় দাবি জানান। ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্? তীব্র প্রতিবাদ জানান, তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি তুলে ধরেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভাষা বিতর্ক সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করা হয়। একই সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে ব্যবহার শুরু করে। বিভিন্ন কিছুতে বাংলা বাদ দিয়ে উর্দুর পাশাপাশি ইংরেজির ব্যবহার শুরু করে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরিত উচ্চতর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সার্কুলারে ৯টি ভাষায় পরীক্ষার উল্লেখ থাকলেও বাংলা ভাষা বাদ দেয়া হয়। সে সময় এ অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ৫ ডিসেম্বর ছাত্র-শিক্ষকদের সমাবেশে মওলানা আকরম খাঁ বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে বিদ্রোহের হুমকি দেন। ডিসেম্বর মাসে ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সভা-সমাবেশ শুরু করে। ৬ ডিসেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে ডাকসু কর্তৃক রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সভা করা হয়। ডিসেম্বর শেষ সপ্তাহে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৮-এর ২৬ ফেব্র্রুয়ারি সিলেট মহিলা মুসলিম লীগের উদ্যোগে সভানেত্রী মিসেস জোবেদা খাতুনের নেতৃত্বে আন্দোলন করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের গণপরিষদে বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে। ১১ মার্চ তারিখে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের ডাকে সর্বাত্মক হরতাল ও বিক্ষোভ পালিত হয়। সরকারি-বেসরকারি লোকজন মিছিলে যোগ দেন। ১৩ মার্চ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট হয়। ১৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ১৫ জন আহত হয়। ২০ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ২১ মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে ছাত্ররা আন্দোলনে ফেটে পড়েন। ২৮ মার্চ জিন্নাহ রেডিওর ভাষণে ভাষা আন্দোলনকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে বলেন। এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছাত্রদের ওপর চড়াও হয়, চলে গ্রেপ্তার নির্যাতন।

১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা সচিব ফজলুর রহমান পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত এক সভায় মাধ্যমিক শিক্ষায় উর্দুভাষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলেন। এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের নাম উর্দুতে লেখার সময় সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা হয়। ১৯৫০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুভাষার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের জন্য কমিটি গঠন করে। এভাবে ১৯৫২-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে নানা আন্দোলন। উর্দু সমর্থকরা বাংলার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তাঁরা বাংলাকে হিন্দু সংস্কৃতি ও পৌত্তলিকতার ভাষা বলে মনে করতেন। তবে বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিল উর্দু ভাষীরা প্রাধান্য পাবে এবং বাঙালিদের জ্ঞানের অজুহাত দেখিয়ে রহিত করা হবে। সে সময়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাঙালি লেখকরাও এগিয়ে এসেছিলেন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য।

বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তর এক ভাষাভাষী রাষ্ট্র। বলা যায়, বাঙালির ভাষাভিত্তিক আন্দোলন থেকেই ধাপে ধাপে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের সফল অধ্যায় রচিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙালি জাতি, রাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সংখ্যালঘু হলেও তাদের হাতেই ছিল রাষ্ট্রের সব চাবিকাঠি। শাসন ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সব কিছুতেই তারা মুরব্বিসুলভ আচরণ করত। আর সেই মুরব্বিআনা খাটিয়ে আমাদের উন্নত ও প্রাচীন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। বাংলার স্বাধীনচেতা ভাষামোদী জনগণ তা মেনে নিতে পারেনি। সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সে সময়ের প্রতিবাদী তরুণরা মিছিল বের করে আত্মত্যাগ দিয়ে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। একটি দেশ নতুনরূপে আত্মপ্রকাশের পর নতুন রাষ্ট্রের বহুবিধ সমস্যা থাকে।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা চিন্তা না করে অহেতুক রাষ্ট্রভাষায় প্রশ্ন উত্থাপন করে পাকিস্তানের জাতীয় জীবনে প্রচণ্ড বিতর্কের সৃষ্টি করে। অনেক উন্নত ও সভ্য দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা চালু আছে কিন্তু পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ তাও ভাবতে পারেনি। কিছুসংখ্যক বাংলাদেশের দোসর পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ধ্বংসের অজুহাত তুলে উর্দুকে ইসলামী ভাষা হিসেবে চালু করার চেষ্টা করে। সাম্প্রদায়িকতাকে মূলধন করে বাংলার মানুষকে শোষণের শিকারে পরিণত করতে চেয়েছিল। কিন্তু অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সুপ্ত জাতিসত্তা জেগে ওঠে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। যা বাংলা ভাষায় রচিত পৃথিবীর প্রথম ও একমাত্র রাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র। জাতিসংঘের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলায় ভাষণ দিয়ে ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা ভাষার মর্যাদা। তিনি বিশ্ব সংস্থায় সাধারণ অধিবেশনে বিশ্ব সমাজের কাছে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের কথা তুলে ধরেছিলেন মাতৃভাষার মাধ্যমে। স্বাধীনতা লাভকারী বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দান ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেলেও জাতিসংঘে পাকিস্তানিদের প্রতিনিধিত্ব থাকায় বাংলায় ভাষণ দান ছিল দুরূহ। তবে সুখের বিষয়, যে পাকিস্তান এক সময় আমাদের ভাষার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেই পাকিস্তান ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পক্ষে সমর্থন দেয়।

মা, মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা আমাদের প্রিয় আপনসত্তা। এই সত্তার মান রক্ষা করতে বাঙালি সমাজ একবিন্দু কার্পণ্য করেনি। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জনের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে কেবল আমাদের দেশেই। যা বিরল কীর্তিগাথা ও অতুলনীয় এক ত্যাগ ও সাহসের মহাকাব্য। অধিকার আদায়ের সচেতনতা, মনোবল ও অদম্য সাহসের মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছে বাঙালির মুক্তির স্পৃহা। বায়ান্নের আত্মত্যাগী শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃত হয়েছে শহীদ দিবসে, সারাদেশে বাংলার গ্রামগঞ্জে তৈরি হয়েছে শহীদ মিনার। এই দিনে হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থ সব ভুলে গিয়ে প্রতিটি বাঙালি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে শহীদদের।

সবারই মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের মাতৃভাষা আমাদের আত্ম পরিচয়ের চিহ্ন। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা যেন গতানুগতিক নানা আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা আমাদের আরেক বিজয়। তাই মাতৃভাষার গৌরবগাথা অহংকারের স্মৃতি যাতে অম্লান না হয় এবং ভাষার মর্যাদা ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত