ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মার্কিন-ইসরায়েলি হুমকিতে নতিস্বীকার করবে না হামাস

‘তেলআবিব চুক্তি মেনে না চললে কোনো বন্দি মুক্তি পাবেন না’
মার্কিন-ইসরায়েলি হুমকিতে নতিস্বীকার করবে না হামাস

ইসরায়েলি বন্দিদের ব্যাপারে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির কাছে নতিস্বীকার করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। এক বিবৃতিতে সংগঠনের এই কঠোর অবস্থান তুলে ধরেন হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম। তিনি বলেন, ইসরায়েল গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির বেশ কয়েকটি ধারা লঙ্ঘন করেছে; কাজেই তেলআবিব পুরোপুরি চুক্তি মেনে না চলা পর্যন্ত আর কোনো পণবন্দি মুক্তি পাবেন না। কাসেম বলেন, ‘আমাদের অবস্থান স্পষ্ট, আমরা যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের হুমকির ভাষা মেনে নেব না।’ আগামী শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরের মধ্যে পণবন্দিরা মুক্তি না পেলে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় আবার ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু করার যে হুমকি দিয়েছেন, তার জবাবে হামাসের এই কঠোর অবস্থান ঘোষিত হলো। তাছাড়া, বুধবার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, পণবন্দিরা মুক্তি না পেলে এবার গাজায় আগের চেয়েও ধ্বংসাত্মক হামলা চালানো হবে। ইহুদিবাদী কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সম্প্রতি বলেছেন, আগামী শনিবারের মধ্যে হামাস সব বন্দিকে মুক্তি দিতে ব্যর্থ হলে গাজার জন্য জাহান্নামের দরজা খুলে দেওয়া হবে। ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্ব গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। চুক্তিতে বর্ণিত সময়সীমা মেনে হামাস ও ইসরায়েল পরস্পরের বন্দিদের ঠিকমতো মুক্তি দিয়ে এলেও গাজাবাসীর ওপর হামলা না চালানো এবং এই উপত্যকায় অবাধে ত্রাণ প্রবেশ করতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি মেনে চলছে না তেলআবিব। এর প্রতিবাদে গত শনিবার সর্বশেষ তিন বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার পর হামাসের সামরিক মুখপাত্র আবু ওবায়দা হুমকি দেন, তেলআবিব যুদ্ধবিরতি চুক্তি পুরোপুরি মেনে চলতে ব্যর্থ হলে ১৫ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী নির্ধারিত দিনের পণবন্দি মুক্তির প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হবে। আবু ওবায়দার ওই ঘোষণার জবাবেই মূলত মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা গাজায় আবার আগ্রাসন চালানোর হুমকি দিয়েছেন। এদিকে, ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদ আন্দোলন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, গাজায় হামাসের হাতে আটক বন্দিদের কিছু হলে সেজন্য তেলআবিবকে দায়ী থাকতে হবে। ইসলামি জিহাদের সামরিক শাখা আল-কুদস ব্রিগেডস বুধবার এক বিবৃতিতে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করলেও ইহুদিবাদী শত্রু তার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করার মাধ্যেমে গাজায় আটক বন্দিদের জীবন বিপণ্ণ করে তুলেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু কী পদক্ষেপ নেন, তার ওপর গাজায় আটক বন্দিদের ভালো অথবা খারাপ পরিণতি নির্ভর করছে। এতে আরও বলা হয়, ইহুদিবাদী শত্রু যুদ্ধবিরতি মেনে চললে প্রতিরোধ যোদ্ধারাও চুক্তির প্রতিটি ধারা মেনে চলবে।

এএফপি জানিয়েছে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে চলা দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করছে মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার ও মিসর। ফিলিস্তিনি একটি সূত্র বুধবার সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা কথা বলেছেন। তারা এই দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করছেন এবং চুক্তি অনুযায়ী যে-সব ত্রাণ ও সরঞ্জাম পাঠানোর কথা রয়েছে, সেটি মানতে ইসরায়েলকে বাধ্য করানোর চেষ্টা করছেন। তাছাড়া যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরুর ওপরও গুরুত্বারোপ করছেন তারা।’

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এবং জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বুধবার ফোনালাপে গাজার বিষয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন। মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জর্ডানের রাজার বৈঠকের পর এই ঘোষণা এলো। মিসরীয় প্রেসিডেন্সির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই নেতা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার পুনর্গঠনে মিসর ও জর্ডানের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিশ্চিত করেছেন, যাতে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে উৎখাত না করা যায়।’ জর্ডানের রাজকীয় আদালতের আরেকটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই নেতা ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিরুদ্ধে তাদের একীভূত অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। উভয় বিবৃতিতে ট্রাম্পের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তি অর্জনের লক্ষ্যে সহযোগিতার কথাও বলা হয়। আরব নিউজ বলেছে, গাজার ফিলিস্তিনিদের মিসর ও জর্ডানে স্থানান্তরের যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন ট্রাম্প, মিসর ও জর্ডান এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সমন্বিত আরব অবস্থানের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, যদি দুই দেশ ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ না করে, তবে তিনি তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সহায়তা বন্ধ করে দেবেন। মঙ্গলবার ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর রাজা আবদুল্লাহ সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান অবিচল। এটি আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান।’ মিসর ঘোষণা করেছে, চলতি মাসে তারা আরব দেশগুলোর একটি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করবেন এবং গাজার পুনর্গঠনে এমন একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করবেন, যা ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমিতে টিকিয়ে রাখবে। এদিকে, মিসরের দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গাজাবাসীদের তাদের জন্মস্থান থেকে সরানোর কথা হলে কিংবা বিষয়টি বৈঠকের এজেন্ডায় রাখলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করবেন না মিসরের প্রেসিডেন্ট। ১ ফেব্রুয়ারি টেলিফোনে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেন সিসি। ওই সময় সিসিকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প। মিসরের প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ট্রাম্পের সঙ্গে সিসির বৈঠকের দিনক্ষণ এখনও নির্ধারিত হয়নি।

দ্য নিউ অ্যারাবের খবরে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকাকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়েছে সৌদি আরব। দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একনাগাড়ে সমালোচনা করে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশটির সরকারও কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, হামাসকে এতদিন শত্রু ও সন্ত্রাসী মনে করে এলেও তাদের প্রতি সুর নরম করেছে সৌদি মিডিয়া। সম্প্রতি গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বিতাড়িত করার হুমকি দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এর মধ্যে গাজাবাসীকে সৌদিতে স্থানান্তরের কথা বলেন নেতানিয়াহু। খবরে বলা হয়, আগে সৌদির সংবাদমাধ্যমগুলো পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে কথা বলত। এখন তারা সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। নেতানিয়াহু যখন সৌদিতে ফিলিস্তিনিদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের হাস্যকর প্রস্তাব দেন, তার কিছুক্ষণ পরই কড়া ভাষায় বিবৃতি দেয় সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা নেতানিয়াহুর প্রস্তাব নিয়ে বলেছেন, ‘এ-সব উগ্রবাদী বক্তব্য এবং দখলদারিত্বের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, যারা ফিলিস্তিনি অধিকার উপলব্ধি করতে পারেন না।’ মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ‘ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ডের ওপর বৈধ অধিকার রয়েছে। তারা বাইরে থেকে আসেননি বা কোনো অভিবাসী নয়, যাদের ইসরায়েলের ইচ্ছায় উচ্ছেদ করা যাবে।’ দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আল-ইখবারিয়াকে এক বিশ্লেষক বলেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে রাষ্ট্র শব্দটি আর যায় না।’ অথচ সৌদি দুই বছর আগেও ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিল। আল-ইখবারিয়া নেতানিয়াহুর তীব্র সমালোচনা করে তাকে ‘ইহুদিবাদী এবং ইহুদিবাদীর সন্তান’ হিসেবে অভিহিত করেছে। অপরদিকে, আল-আরাবিয়া নেতানিয়াহুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলেছেন, হয়ত মানসিক সমস্যার কারণে তিনি এমন প্রস্তাব দিয়েছেন। হামাসের প্রতি দেশটির সংবাদমাধ্যমের মনোভাবও হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করলেও গাজাবাসীদের নিয়ে হামাসের দেওয়া দুটি বিবৃতি তারা প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি আশরাক আল-আওসাত নামে একটি সংবাদমাধ্যম হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ইজ্জাত আল-রিশকের বক্তব্য প্রকাশ করেছে। সৌদির লেখক নওয়াফ আল-কুদাইমি এটিকে একটি অসাধারণ মুহূর্ত হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেছেন, সৌদি চাইলে এখন হামাসের সঙ্গে প্রতীকী সম্পর্ক গড়তে পারে। তারা চাইলে এবারের রমজানে হামাসের নেতাদের ওমরাহ করার সুযোগ দিতে পারেন।

চীন জোর দিয়ে বলেছে, অবরুদ্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিনিদের এবং এটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গাজার জনগণকে জোরপূর্বক সেখান থেকে উচ্ছেদ করার বিরোধী বলেও চীন সরকার সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছে। বুধবার প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুয়ো জিয়াকুন এ-সব কথা বলেন। গাজা দখল এবং সেখানে ফিলিস্তিনিদের ফিরতে না দেওয়ার মার্কিন পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পর চীনের পক্ষ থেকে এই প্রতিক্রিয়া এলো। চীনা মুখপাত্র জোর দিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ জাতীয় অধিকারকে চীন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং গাজাবাসীদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিরোধিতা করে। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিরাই ফিলিস্তিনকে শাসন করবেন; এটিই হবে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা শাসনের মূলনীতি। মুখপাত্র গাজায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন এবং সেখানে মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত