জম্মু কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের তীব্র বাকযুদ্ধ চলছে। সীমান্তের একদিকে যেমন ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের’ দাবি জোরালো হয়েছে তেমনই অন্যপ্রান্তে ‘সমুচিত জবাব’ দেয়ার দৃঢ় সংকল্প নেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত সামরিক পদক্ষেপে গড়ায় কি না তা নিয়েই চলছে ব্যাপক জল্পনাকল্পনা। গত শুক্রবার রাতে ফের গোলাগুলি হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের সেনাদের মধ্যে। ভারতের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নিয়ন্ত্রণরেখার (এলওসি) বিভিন্ন পয়েন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাচৌকি থেকে ‘উসকানিমূলকভাবে’ হালকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালানো হয়। জবাবে ভারতীয় বাহিনীও পালটা গুলি ছোড়ে। ভারতের সেনাবাহিনীর দাবি, গত বৃহস্পতিবার রাতেও পাকিস্তানি বাহিনী থেমে থেমে গুলি চালিয়েছিল। তবে ওই ঘটনায় ভারতীয় দিক থেকে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছে। তেমনি এক বিক্ষোভে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলওয়াল ভুট্টো-জারদারি শুক্রবার বলেছেন, পিপিপি যেমন ঐকমত্য ছাড়া বিতর্কিত খাল প্রকল্পের অনুমতি দেয়নি, তেমনি পাকিস্তানিরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং সিন্ধু নদীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগ্রাসনের তীব্র জবাব দেবে। খবর জিও নিউজ। সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্থগিত করার বিষয়ে ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে তিনি নয়াদিল্লিকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সিন্ধু আমাদের এবং আমাদেরই থাকবে। সিন্দুতে হয় আমাদের পানি প্রবাহিত হবে, নয়তো তাদের (ভারত) রক্ত।
সুক্করে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিলওয়াল ভুট্টো জনগণকে অভিনন্দন জানান এবং বলেন, তাদের শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের সাফল্যের জন্যই ফেডারেল সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সাধারণ স্বার্থ পরিষদের (সিসিআই) ঐকমত্য ছাড়া সিন্ধু নদের ওপর কোনো খাল নির্মাণ করা হবে না। তিনি আরও বলেন, পিপিপি এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। এতে উভয় দলের নেতারা স্বাক্ষর করেছেন। এখন পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক নীতি হলো যে, সব প্রদেশের পারস্পরিক সম্মতি ছাড়া কোনো নতুন খাল নির্মাণ করা হবে না।
বিতর্কিত প্রকল্পের বিরুদ্ধে পিপিপি কর্মীদের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, তারা মাঠে না নামলে এটা সম্ভব হতো না। তিনি আরও বলেন, আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, আমরা সিন্ধুকে রক্ষা করব এবং আজ, সিন্ধু এই হুমকি থেকে সুরক্ষিত হয়েছে। এটি তোমাদের বিজয়। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠক এবং আলোচনার সময় সম্মত হওয়া বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করে বিলওয়াল ভুট্টো উল্লেখ করেন, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে ফেডারেল সরকার প্রকল্পটি সিসিআইর সামনে উপস্থাপন করবে। তিনি বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের প্রতি কৃতজ্ঞ, যিনি আপনাদের (জনগণের) উদ্বেগের কথা শুনেছেন এবং এখন কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলো- পিএমএলএন এবং পিপিপি- একমত হয়েছে যে, আপনার সম্মতি ছাড়া কোনো নতুন খাল নির্মাণ করা হবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী এবং ফেডারেল সরকার কর্তৃক অনুমোদিত তার সঙ্গে করা চুক্তি আবারও স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করেছে যে, সব প্রদেশের পানির ওপর ন্যায্য দাবি রয়েছে এবং ১৯৯১ সালের পানি চুক্তি ও ২০১৮ সালের পানি নীতি উভয়ই পারস্পরিক ঐকমত্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
নিজের ব্যর্থতা লুকানোর জন্য মোদি সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। এমনটা উল্লেখ করে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বিলওয়াল ভুট্টো বলেন, সিন্ধু আবারও আক্রমণের মুখে পড়েছে- এবার ভারতের আক্রমণের মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, ভারতের অবৈধভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, যার জন্য নয়াদিল্লি পাকিস্তানের ওপর মিথ্যাভাবে দোষ চাপিয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা করে, কারণ সন্ত্রাসবাদের কারণে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারত নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে পাকিস্তানের ওপর দায় চাপাচ্ছে বলেও মন্তব্য করে পাকিস্তান পিপলস পার্টির এই চেয়ারম্যান বলেন, কোনো প্রমাণ ছাড়াই ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে ভারত অবৈধভাবে সিন্ধু চুক্তি বাতিল করছে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক যখন জটিল আকার ধারণ করছে- তখন হামলার ঘটনার নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক তদন্তে অংশ নিতে প্রস্তুতির কথা জানিয়ে শান্তিপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। গতকাল শনিবার কাকুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির একটি প্যারেড অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পেহেলগামের সাম্প্রতিক হৃদয়বিদারক ঘটনার দায় চাপানোর খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যে কোনো নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে অংশ নিতে আগ্রহী।’ এই বক্তব্য এমন সময় এলো, যখন ভারতের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, হামলাকারীদের আন্তঃসীমান্ত যোগসূত্র থাকতে পারে। যদিও পাকিস্তান এ ধরনের অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর বলে দাবি করে আসছে।
শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘কাশ্মীর পাকিস্তানের ঘাড়ের শিরার মতো। জাতিসংঘের বহু প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও এ বিরোধ আজও মীমাংসিত হয়নি। পাকিস্তান সব সময় কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান বড় মূল্য দিয়েছে। আমাদের প্রায় ৯০ হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে এবং আমরা ৬০ হাজার কোটি ডলারের বেশি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের একদিন আগেই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস ও স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে পরিচালিত যে কোনো তদন্তে অংশ নিতে প্রস্তুত। ভারত এই হামলাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে এবং প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করছে।’ খাজা আসিফ হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘পাকিস্তানের ভূখণ্ডে যদি ভারতীয় হামলা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে তা পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেবে, যা গোটা অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।’ আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফও। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগ করেন, ভারত সিন্ধু নদের পানিচুক্তি বাতিলের অজুহাত হিসেবে পেহেলগামের হামলাকে ব্যবহার করছে এবং কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ, তদন্ত ছাড়াই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। খাজা আসিফ বলেন, ‘আমরা চাই না যে, যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠুক। কারণ এমন পরিস্থিতি দেখা দিলে সেটি এই পুরো অঞ্চলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।’ ভারত সরকার এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, যদিও ইসলামাবাদ এই দাবি তীব্রভাবে অস্বীকার করে এবং ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ হিসেবেও অভিহিত করেছে। পেহেলগামে হামলার দায় স্বীকার করে এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ভারতের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেছেন, কাশ্মীরের বৃহত্তম বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই তৈয়বার (এলইটি) একটি উপশাখা এই টিআরএফ। তবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘লস্কর-ই তৈয়বার যারা এখনও জীবিত আছেন, তাদের কেউ কারাগারে আছেন, কেউ বা গৃহবন্দি। এই গোষ্ঠীটির কেউই এখন আর সক্রিয় নয় এবং পাকিস্তানে তাদের কোনো সাংগঠনিক তৎপরতাও নেই।’
পাকিস্তান আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়ায় এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগোর মতো ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো এখন তাদের আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট ঘুরপথে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে তাদের জ্বালানি বাবদ বেশি খরচ হবে এবং ভ্রমণের সময়ও বেড়ে যাবে। কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীর হামলার ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় বিমানসংস্থার জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান। নিষেধাজ্ঞাটি আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। গত মঙ্গলবার কাশ্মীরের পেহেলগামের একটি খোলামাঠে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। ভারত বলছে, এ ঘটনায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা আছে। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ ঘটনার জেরে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিক পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তদেশীয় নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পাকিস্তান। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে ভারতীয় বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগো তাদের নিউইয়র্ক, আজারবাইজান ও দুবাইগামী ফ্লাইটগুলো ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এসব ফ্লাইট সাধারণত পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে থাকে।
এই নিষেধাজ্ঞার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে নয়াদিল্লির বিমানবন্দরের ওপর। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর। এখান থেকে পশ্চিমা দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া ফ্লাইটগুলো সাধারণত পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহার করে থাকে। ডেটা বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান সিরিয়াম অ্যাসেন্ডের তথ্য বলছে, শুধু এপ্রিল মাসেই ইন্ডিগো, এয়ার ইন্ডিয়া এবং তাদের সুলভ মূল্যের শাখা এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০টি ফ্লাইট নির্ধারিত আছে। এগুলো নয়াদিল্লি থেকে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আমেরিকার দিকে যাবে। ভারতের বেসরকারি বিমান চলাচলসংক্রান্ত এক নির্বাহী বলেছেন, নয়াদিল্লি থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে করে গন্তব্যে পৌঁছাতে গড়ে এক ঘণ্টা বেশি সময় লাগবে। এতে জ্বালানি খরচ যেমন বেশি হবে, তেমনি মাল পরিবহন কমাতে হবে। ওই কর্মকর্তা তার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
একটি বিমান সংস্থার মোট পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৩০ শতাংশই জ্বালানি ও তেল বাবদ হয়ে থাকে। এককভাবে এ খাতটি সবচেয়ে বেশি খরচের। ইন্ডিগো বলছে, প্রায় ৫০টি আন্তর্জাতিক রুটের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা হতে পারে। এছাড়া তারা ঘোষণা দিয়েছে, ২৭ এপ্রিল থেকে অন্তত ৭ মে পর্যন্ত কাজাখস্তানে আলমাতিগামী এবং ২৮ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত উজবেকিস্তানের তাসখন্দগামী ফ্লাইটগুলো বাতিল করা হয়েছে।
ভারতীয় বিমান সংস্থার এক পাইলট রয়টার্সকে বলেন, পাকিস্তানের আকাশসীমায় নিষেধাজ্ঞার কারণে বিমান সংস্থাগুলোকে নতুন করে উড়ান সময় নিয়ে হিসাব-নিকাশ করতে হবে। পাইলট ও ক্রুদের রোস্টারও পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। অন্য এক নির্বাহী বলেন, তার সংস্থার কর্মীরা এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য গত বৃহস্পতিবার অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন। দুই কর্মকর্তার কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
ফ্লাইট অ্যাওয়ারের তথ্য বলছে, গত বৃহস্পতিবার ইন্ডিগোর ৬ই১৮০৩ ফ্লাইটটির (নয়াদিল্লি থেকে আজারবাইজানের বাকু) গন্তব্যে পৌঁছাতে ৫ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট লেগেছে। পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় তাদের বিকল্প একটি দীর্ঘ রুট ব্যবহার করতে হয়েছে। ফ্লাইটটি প্রথমে দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতের গুজরাট রাজ্যের দিকে এগিয়ে যায়, তারপর আরব সাগর পেরিয়ে উত্তর দিকে ঘুরে ইরানের ওপর দিয়ে আজারবাইজানে পৌঁছায়। অথচ গত বুধবার যখন ফ্লাইটটি পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করেছিল, তখন একই যাত্রা সম্পূর্ণ করতে সময় লেগেছিল মাত্র ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট। পাকিস্তান ঘোষণা করেছে, তাদের আকাশসীমা ২৩ মে পর্যন্ত ভারতের জন্য বন্ধ থাকবে। ২০১৯ সালে পাকিস্তান প্রায় পাঁচ মাস আকাশসীমা বন্ধ রেখেছিল। ভারতের সরকারের তথ্য বলছে, ওই সময় এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো এবং অন্য বিমান সংস্থার সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
পেহেলগামে ২৮ জনকে হত্যার কয়েক দিন পর গত শুক্রবার রাতে জম্মু ও কাশ্মীরজুড়ে পাঁচ সন্দেহভাজনের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। তবে হামলার ঘটনার পর এখনও কাউকে আটক করতে পারেনি তারা। কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, শোপিয়ান, কুলগাম ও পুলওয়ামা জেলায় অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। গত কয়েক দিনে সন্দেহভাজনদের ওপর দমন অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। শোপিয়ানের চোপোটিপোরা গ্রামে শাহিদ আহমেদ কুট্টের বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে লস্কর কমান্ডার বলে দাবি করছে ভারত। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কুট্টে গত তিন-চার বছর ধরে সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ সমন্বয় করার ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুলগামের মাতালম এলাকায় আরেক সন্দেহভাজন জাহিদ আহমেদের বাড়িও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলওয়ামার মুররান এলাকায় বিস্ফোরক দিয়ে আহসান উল হক নামে একজনের বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের দাবি, আহসান ২০১৮ সালে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং সম্প্রতি উপত্যকায় ফিরে আসেন। এহসান আহমেদ শেখ নামে একজন সন্দেহভাজনের দোতলা বাড়িও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তিনি লস্কর-ই তৈয়বার সদস্য বলে দাবি করা হচ্ছে, যিনি ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে সক্রিয় ছিলেন। পঞ্চম সন্দেহভাজন হারিস আহমেদের বাড়িও বিস্ফোরক পেতে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলওয়ামার কাচিপোরা এলাকার ওই বাসিন্দা ২০২৩ সাল থেকে সক্রিয় বলে দাবি করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে, পেহেলগাম হামলার মূল সন্দেহভাজন আদিল হুসেন ঠোকর এবং আসিফ শেখের বাড়ি বিস্ফোরণে ধ্বংস করা হয়। গত বৃহস্পতিবার অনন্তনাগ পুলিশ পেহেলগাম হামলায় জড়িত সন্দেহে ঠোকর এবং আরও দুইজনের স্কেচ প্রকাশ করেছিল। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্য দুই সন্দেহভাজন- হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান এবং আলি ভাই ওরফে তালহা আপন ভাই। তারা পাকিস্তানি নাগরিক এবং তাদের গ্রেপ্তারের জন্য ২০ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিয়ে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, দেশ দুটির মধ্যে সবসময়ই উত্তেজনা ছিল এবং তারা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের মধ্যে এর সমাধান করবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি ভারতের খুব কাছের এবং আমি পাকিস্তানেরও খুব কাছের। কাশ্মীরে তাদের লড়াই এক হাজার বছর ধরে চলছে। তিনি আরও বলেন, কাশ্মীর ইস্যু এক হাজার বছর ধরে চলছে, সম্ভবত তারও বেশি। সাম্প্রতিক ঘটনাকে তিনি খারাপ বলেও উল্লেখ করেন।
এর আগে ভারত ও পাকিস্তানকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তার মুখপাত্র এ তথ্য জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব দেশ দুটির মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন।
মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, জম্মু ও কাশ্মীরে সংগঠিত হামলার নিন্দায় আমরা অত্যন্ত স্পষ্ট ছিলাম। ওই হামলায় ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এরই মধ্যে দেশ দুটি একে অপরের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। থেমে নেই কথার লড়াইও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পর এবার এসব বিষয়ে স্পষ্টভাবে বার্তা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও।
মধ্যস্থতার প্রস্তাব ইরানের: ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার কারণে দুই দেশের ‘বোঝাপড়ায় উন্নতির’ জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাঘচি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান ইরানের ভ্রাতৃপ্রতিবেশী, যাদের সম্পর্কের শিকড় তাদের শতাব্দী প্রাচীন সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার বন্ধনের মধ্যে রয়েছে। অন্য প্রতিবেশীদের মতো আমরাও তাদের আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বিবেচনা করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কবি সাদির শেখানো চেতনার সঙ্গে সংগতি রেখে জানাতে চাই, এই কঠিন সময়ে বৃহত্তর বোঝাপড়া গড়ে তোলার জন্য তেহরান কিন্তু ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির সঙ্গে নিজের সুসম্পর্ককে ব্যবহার করতে প্রস্তুত। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর কবি সাদির একটা কবিতাও শেয়ার করেছেন, যার সংক্ষেপে অর্থ হলো ‘মানব সভ্যতা মহাবিশ্বের একটা অংশ এবং যদি একজন কষ্ট পায়, তবে অন্যজনও এতে কষ্ট পাবে। পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গেও কথা বলেছেন। সে বিষয়ে উল্লেখ করে ইসহাক দার লিখেছেন, ‘এই অঞ্চলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য ইরানের প্রচেষ্টার আমরা প্রশংসা করি।’