জম্মু কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহতের ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে। ক্রমেই সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছে। টানা পাঁচ রাত ধরে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি চলছে। ভারতীয় যুদ্ধবিমানকে পাকিস্তানি বাহিনীর ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গভীর রাতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর (পিএএফ) ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে বাঁচল ভারতের চার যুদ্ধবিমান। গত মঙ্গলবার গভীর রাতে নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) কাছে এ ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেছে পিএএফ। বুধবার নিজ নিজ প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন ও দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। সংবাদমাধ্যম দুটির প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তান বিমান বাহিনী (পিএএফ) জানিয়েছে, মঙ্গলবার গভীর রাতে নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) কাছে ভারতের চারটি রাফাল যুদ্ধবিমান শনাক্ত করে তারা। এরপরই তাদের সমন্বিত প্রতিক্রিয়ায় সেগুলো পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে, ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো ভারত-অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের আকাশসীমায় টহল দিচ্ছিল। তখনই পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান তাদের উপস্থিতি শনাক্ত করে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়।
পেহেলগামে বন্দুক হামলার জবাব দিতে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, মঙ্গলবার নিজ বাসভবনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহানসহ তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন মোদি। প্রতিবেদন মতে, বৈঠকে মোদি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌসেনারা ‘যখন খুশি, যেখানে খুশি’ পেহেলগামে হামলার বদলা নিতে পারে। কোথায়-কীভাবে হামলা চালানো হবে, কীভাবে পরিকল্পনা করা হবে- সেই সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো বাহিনীর হাত-পা বেঁধে রাখা হবে না। এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে মোদি তিন বাহিনীর ওপরই পূর্ণ আস্থা রাখছেন বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। সূত্র উদ্ধৃত করে পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী, ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল এপি সিং এবং ভারতীয় নৌসেনার প্রধান অ্যাডমিরাল দীনেশ কুমার ত্রিপাঠীর সামনেই মোদি বলেছেন, আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, কীভাবে হবে সেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। টার্গেট কী হবে এবং কখন-কোথায় অ্যাকশন নেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে (সশস্ত্র বাহিনীর)।
সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এনডিটিভি জানিয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বার্তায় ২৬ জনকে হত্যাকারীদের (কাশ্মীরে) বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা উত্তরোত্তর কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে জম্মু ও কাশ্মীরের আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী পারগাওয়াল সেক্টরে পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী বাহিনী গুলি চালিয়েছে বলে দাবি করছে ভারত। দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, বিগত কয়েক দিনে নিয়ন্ত্রণরেখার (লাইন অব কন্ট্রোল) শর্ত একাধিকবার ভেঙেছে পাকিস্তান। মঙ্গলবার রাতে জম্মু এলাকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে তারা। ভারতীয় বাহিনীয় তার পাল্টা জবাব দিয়েছে। প্রতিবেদনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো বক্তব্য যোগ করা হয়নি। এর আগে, নিয়ন্ত্রণরেখাজুড়ে পাকিস্তান বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাদের দাবি, পাকিস্তানের গুলির সমুচিত জবাব দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণরেখা ভিন্ন বিষয়। আন্তর্জাতিক সীমান্ত হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা। আর নিয়ন্ত্রণরেখা মূলত একটি অস্ত্রবিরতি রেখা। এটি দুদেশের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে শান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যে নির্ধারিত হয়েছে। এই রেখা বরাবর গোলাগুলি চালানো চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। কাশ্মীরে হামলার ঘটনা জানামাত্রই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলেছেন তিনি।
জাতিসংঘের বিবৃতিতে বলা হয়, কাশ্মীরে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন গুতেরেস। সব পক্ষকে সতর্ক করে তিনি বলেন, আইন মেনে হামলাকারীদের জবাবদিহি ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ভারত ও পাকিস্তানের কোনো সংঘর্ষে জড়ানো উচিত হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, সংঘর্ষের ফলে কেবল গভীর মানবিক সংকট সৃষ্টি হবে।
এদিকে ভারত ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে হামলা চালাতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার। এ বিষয়ে বুধবার তিনি বলেন, বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, ভারত আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে ভারত পেহেলগাম ঘটনায় জড়িত থাকার ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট অভিযোগের অজুহাতে আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে। আতাউল্লাহ তারার বলেন, পাকিস্তান এই অঞ্চলে ভারতের এমন আগ্রাসী ভূমিকা এবং বেপরোয়া আচরণকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান নিজেই সন্ত্রাসবাদের শিকার এবং এই অভিশাপের যন্ত্রণা সত্যিই তারা জানে।
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা বিশ্বের যে কোনো স্থানে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছি। তিনি বলেন, একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান এই হামলার সত্যতা নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞদের একটি নিরপেক্ষ কমিশন দ্বারা একটি বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ এবং স্বাধীন তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, যুক্তির পথ অনুসরণ করার পরিবর্তে ভারত স্পষ্টতই অযৌক্তিকতা এবং সংঘাতের বিপজ্জনক পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পরিণতি এই অঞ্চল এবং তার বাইরেও বিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভারতের এ ধরনের সামরিক অভিযানের জবাব নিশ্চিতভাবে এবং চূড়ান্ত আকারে দেওয়া হবে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে ‘ভারতকে থামানোর’ অনুরোধ জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। একইসঙ্গে নয়াদিল্লিকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাতেও বলেন তিনি। ইসলামাবাদ থেকে দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানায়, মঙ্গলবার জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এই আহ্বান জানান। আলোচনায় দুই নেতা দক্ষিণ এশিয়ার চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। শাহবাজ বলেন, ‘ভারতের কোনো দুর্ভাগ্যজনক আচরণের জবাবে পাকিস্তান তার সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, সিন্ধু নদীর পানিকে অস্ত্র বানানোর যে প্রয়াস ভারত নিচ্ছে, তা পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে এক হামলায় ২৬ জন ভারতীয় পর্যটকের মৃত্যুর পর ভারত পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। তবে এ অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ উল্লেখ করে শাহবাজ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের তদন্তের প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের প্রধানন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাস করি না। বরং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আমরা ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করেছি।’ একইসঙ্গে কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়ে দমন করার ভারতীয় কৌশলকে হতাশাজনক ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।
শাহবাজ বলেন, ‘কাশ্মীরে ভারতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দমন-পীড়নই আসল সন্ত্রাস। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নিতে তারা পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করছে।’ তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবকে বলেন, সিন্ধু অববাহিকার পানিকে পাকিস্তানের ২৪ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনীশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারত যদি পানি নিয়ে কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়, তবে তা যুদ্ধ ঘোষণার সামিল বলে গণ্য হবে। আলোচনায় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার ক্রমবর্ধমান গতিপথে গভীর উদ্বেগ জানান এবং সংঘাত এড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি দুঃখজনক পরিণতির দিকে যেতে পারে।’ উত্তেজনা হ্রাসে গুতেরেস নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী বলেও জানান। এদিকে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছেন, মহাসচিব ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে আলাপ করেছেন। তিনি উভয় পক্ষকে আইনি পথে ন্যায়ের পথ অনুসরণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে বলেছেন।
পাকিস্তান প্রথমে ভারতে হামলা চালাবে না, তবে কোনো ধরনের আঘাত এলে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে মঙ্গলবার সিনেটে একথা জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। পেহেলগামে হামলার প্রেক্ষিতে ভারতের অভিযোগ মোকাবিলায় পাকিস্তান যে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আনা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ইসলামাবাদ থেকে ডন জানায়, সিনেট অধিবেশনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সদস্য সৈয়দ মাসরুর আহসান পিটিআইয়ের প্রস্তাবিত সর্বদলীয় বৈঠকে ইমরান খানকে আমন্ত্রণ জানানোর পক্ষে সমর্থন দেন। পিটিআইয়ের আউন আব্বাস বলেন, নওয়াজ শরিফ, আসিফ আলী জারদারি ও ইমরান খানের সম্মিলিত উপস্থিতি জাতিকে ঐক্যের বার্তা দেবে। মাসরুর আহসানও বলেন, সরকারকে নমনীয়তা দেখাতে হবে, বিরোধীদের কথা শুনতে হবে এবং উভয় পক্ষকে অহংকার ত্যাগ করতে হবে।
এসময় তিন সিনেটর- আল্লামা নাসির আব্বাস, গুরদীপ সিং ও দোস্ত মোহাম্মদ পিটিআই নেতা ইমরান খানের মুক্তির দাবি জানান। তবে পিএমএল-এনের সিনেটর নাসির বাট বলেন, ইমরান খানকে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। সিনেটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, পেহেলগাম হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, আজারবাইজান, কুয়েত, বাহরাইন, হাঙ্গেরি ও কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেছে। চীন ও তুরস্কের অবস্থানেরও প্রশংসা করেন তিনি। দার বলেন, ‘আমি তাদের পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছি- ভারতের মনোভাব, ইতিহাস ও সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছি। আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।’
তিনি ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার কথাও উল্লেখ করেন, যার পর ভারত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। সেই ঘটনার অনুরূপ পরিস্থিতি তৈরি করে ভারত আবারও কৌশলগত উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় বলেও মত দেন দার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ভারত দুই বছর ধরে সিন্ধু পানি চুক্তি পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। তার মতে, পেহেলগাম হামলার ঘটনাকে সেই চুক্তি স্থগিতের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। ইসহাক দার বলেন, ‘পাকিস্তান এই হামলায় জড়িত নয় এবং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এরইমধ্যে স্বাধীন তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছেন, কারণ আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানি- এতে পাকিস্তানের কোনো ভূমিকা নেই। তিনি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের পানিতে ভারতের কোনো হস্তক্ষেপ যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে এবং তা কখনওই বরদাশত করা হবে না।’
এদিকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মেয়ে ও পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়াম নওয়াজ বলেছেন, আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও দেশের স্বার্থে সবাইকে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়াতে হবে। বুধবার পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য ডনের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়। মরিয়াম নওয়াজ বলেছেন, পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ায় কোনো শত্রু দেশে আক্রমণের সাহস করবে না। তিনি বলেন, আজ পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে। কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের সেনাবাহিনী দেশের প্রতিরক্ষায় সম্পূর্ণ সক্ষম। পাকিস্তানের শত্রুরা জানে-এই দেশ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। মরিয়াম নওয়াজ আরও বলেন, আমাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য যা-ই থাকুক না কেন, দেশের বিরুদ্ধে যদি কোনো বহিরাগত আগ্রাসন আসে, তাহলে সবাইকে একসঙ্গে সেনাবাহিনীর পাশে ইস্পাতের প্রাচীরের মতো দাঁড়াতে হবে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের শক্তির মূল উৎস হচ্ছে শহিদদের আত্মত্যাগ। এসময় তিনি দাবি করেন, নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন।
পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা ও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানে প্রাসঙ্গিক হয়েছেন কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। দেশটিতে দাবি উঠেছে পাকিস্তানের এই ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে ইমরান খানকে মুক্তি দেওয়া নিয়েও। কারাগারে থাকাবস্থায়ই হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদির আগ্রাসন ও যুদ্ধপ্রবণ মনোভাবের নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, মোদির আগ্রাসন ও তাদের শত্রুতা পাকিস্তানের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেলে আটক আছেন পাকিস্তানের আলোচিত এই রাজনীতিবিদ। সেখান থেকেই মোদি ও ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। যা পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে।
কারাগারে থেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুদ্ধপ্রবণ মনোভাবের নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ পার্টির (পিটিআই) নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি বলেছেন, আমরা পাকিস্তানের বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করলেও মোদির যুদ্ধপ্রবণ মনোভাব এবং তাদের আঞ্চলিক শান্তির হুমকির বিরুদ্ধে আমরা সকল পাকিস্তানি ঐক্যবদ্ধ আছি। আমরা মোদির বিপজ্জনক উচ্চাকাঙ্ক্ষার তীব্র নিন্দা জানাই। সাবেক ওই প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, একটি ভুয়া ফর্মণ্ড৪৭ এর মাধ্যমে গঠিত অবৈধ সরকার দেশের জনগণকে বিভক্ত করেছে। কিন্তু মোদির সাম্প্রতিক আগ্রাসী আচরণ উল্টো দেশের জনগণকে জাতীয় স্বার্থে একত্রিত করেছে।
পেহেলগাম হামলার ঘটনায় নিহত ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন ইমরান খান। বলেছেন, আত্মসমালোচনা এবং তদন্তের পরিবর্তে, মোদি সরকার আবারও পাকিস্তানের উপর দোষ চাপাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা ঘটনার সময়ও আমরা সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু ভারত কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। আমি তখনই বলেছিলাম, ভবিষ্যতে আবার এমনই ঘটবে। এখন পেহেলগাম ঘটনার পর সেটাই দেখা যাচ্ছে।
এদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। নিউইয়র্ক থেকে ইউএন নিউজ জানায়, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, ‘আজ (মঙ্গল) সকালে তিনি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ শাহবাজ শরিফের সঙ্গে টেলিফোনে আলাদাভাবে কথা বলেছেন এবং দিনের শুরুতে তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রাহ্মণ্যম জয়শঙ্করের সঙ্গেও কথা বলেছেন।’
ফোনালাপের সময় জাতিসংঘ প্রধান ২২শে এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং ‘আইনি উপায়ে এই হামলার জন্য ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা অর্জনের গুরুত্ব’ উল্লেখ করেন। ডুজারিক আরও বলেন, ‘তিনি ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এমন সংঘর্ষ এড়াতেও জোর দিয়েছেন যার পরিণতি দুঃখজনক হতে পারে।’
মহাসচিব যে কোনো উত্তেজনা প্রশমন প্রচেষ্টার সমর্থনে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দিয়েছেন। বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের বেশিরভাগ পর্যটক। নয়াদিল্লির অভিযোগ, হামলার সঙ্গে ইসলামাবাদ জড়িত। ইসলামাবাদ তা নাকচ করে দিয়েছে। তবে এরই মধ্যে হামলার জেরে পাকিস্তানের সঙ্গে করা ৬৫ বছরের পুরোনো সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। জবাবে পাকিস্তানও পাল্টা বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এর পর থেকে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। পেহেলগামের হামলার পর ভারত দুজন সন্দেহভাজন হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ করেছে, যারা পাকিস্তানি বলে দাবি করেছে নয়াদিল্লি। কিন্তু হামলার সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় এই হামলার নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে ইসলামাবাদ।