আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে দেশের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। এই সিদ্ধান্তে দেশের মানুষের সমর্থন ছিল। তাই কোথাও কোনো আন্দোলন হয়নি বলে মনে করছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে প্রেস সচিব এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিআরইউর সভাপতি আবু সালেহ আকন। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল।
প্রেস সচিব বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের সব অধিকার খর্ব করেছিল। এজন্য আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিল। সব দলের সঙ্গে সরকারের কনসালটেশন (পরামর্শ) হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত ৯ মাসে কেন আওয়ামী লীগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে ম্যাচুরিটির (পরিপক্বতা) বিষয় আছে। জনগণ আওয়ামী লীগের মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা দেখতে চেয়েছে। কিন্তুদুই হাজার মানুষ মারা গেলেও গত ৯ মাসে তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখিনি। এজন্য আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।’ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী, জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, এ বিষয়ে তো ২০১২ সালে আওয়ামী লীগই অ্যাকশন নিয়েছে। একাত্তরের পরে তাদের (জামায়াত) ব্যান (নিষিদ্ধ) করা হয়েছে। এখানে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান হচ্ছে, ইমেডিয়েট পাস্টে (নিকট অতীতে) যা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সেসব অপকর্ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাহলে কি সরকার একাত্তরকে এড়িয়ে যাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘একাত্তর নিয়ে আমরা অনেক স্টেটমেন্ট (বিবৃতি) দিয়েছি। নতুন কিছু বলতে চাই না। একাত্তর আমরা পুরোপুরি ধারণ করি।’
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়েছে, ১৪ দলের কী হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে আওয়ামী লীগের কথা বলা হয়েছে। সেখানে শেখ হাসিনার ভূমিকা বারবার স্পষ্ট হয়েছে। ১৪ দলের অন্য দলগুলোর কথা সেভাবে আসেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো ত্রুটি বা ব্যর্থতা পেলে মন খুলে লেখার আহ্বান জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা কারও মুখ বন্ধ করছি না। সবাইকে অনুরোধ, আপনারা আমাদের কোনো ফেইলিউর (ব্যর্থতা) পান, লেখেন। সমালোচনা করার জায়গা পেলে করুন। আপনার মুখ বন্ধ করা হবে না। মিডিয়া হাউস বন্ধ করা হবে না। কিন্তু মিথ্যা কথা লিখবেন না।’
ভারতে বাংলাদেশি সাতটি টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেল বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, ‘এটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। আমরা এটি দেখছি। এতে বোঝা যায়, তারা আসলে সত্য কথাকে নিতে পারছে না। তবে আমরা পাল্টা অ্যাকশনে যাব না। এতে তাদের (ভারত) অ্যাকশনকে বৈধতা দেওয়া হবে। আমরা জানি, তাদের মিডিয়া প্রতিদিন তামাশা করে।’ শেয়ারবাজারের দরপতন নিয়ে এক সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা শেয়ারবাজারে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলেছেন। তবে এক ডাকাতকে সরিয়ে আরেক ডাকাতকে আনার মতো ঘটনা যেন না ঘটে। শেয়ারবাজার যাতে ডাকাতদের আড্ডাখানা না হয়, সেটাও চিন্তা করতে হবে। ‘প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি অভিজ্ঞদের এনে শেয়ারমার্কেট সংস্কার করার পক্ষে। কিন্তু ভেস্টেড (স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী) কোনো গ্রুপের কাছে যাতে শেয়ারমার্কেটকে না দেওয়া হয়। ক্লিনআপ প্রসেসটা ঠিকমতো করতে পারলে শেয়ারমার্কেট উঠবে (স্বাভাবিক পর্যায়ে যাবে)’, বলেন প্রেস সচিব।
গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি, গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট ও গ্রামীণ টেলিকমের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, ‘এই বিষয়গুলোতে সরকারের কোনো ইনফ্লুয়েন্স আছে কি না, খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ড. ইউনূস কি কোনো সুবিধা পান, তার কোনো শেয়ার আছে? এসব ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠান কি না? আমার জানামতে, তার কোনো পারসোনাল প্রপার্টি নেই।’ জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘৩০ কর্মদিবসের মধ্যে এটি হবে। সে পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাই।’ সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, ‘এজন্য হাই পাওয়ার তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তারা দেখবেন, কার কী কী রোল ছিল, কী ত্রুটি ছিল, সব তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে প্রেস সচিব বলেন, ‘এ বিষয়ে পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) সঙ্গে কথা বলেছি। তারা দেখছে, সে সময় কাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কারা জেলে ছিল। তাদের প্রত্যেককে পুরোনো ট্রেইল ধরে এগোনো হচ্ছে। এটা খুব কষ্টসাধ্য। সর্বশক্তি দিয়ে এই জায়গায় কাজ করছে তারা। ক্লু বের করার চেষ্টা করছে।’ শফিকুল আলম বলেন, ইউটিউব, ফেসবুক, রিল বা টিকটকে যারা মিথ্যা নিউজ দিচ্ছেন, টিভি বা ইউটিউবে কমেন্ট্রি দিচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলছেন। তাদের কেউ ফ্যাক্ট চেকিং করছে না। আমরা আহ্বান করছি, প্রাইভেট কোনো গ্রুপ যাতে তাদের কমেন্ট্রির ওপর ফ্যাক্ট চেকিং করে। সরকারের তরফ থেকেও কী করা যায়, সেটি তারা ভাবছেন। প্রেস সচিব আরও বলেন, গত ১৫ বছর সাংবাদিকদের অনেকে সরকারের ভয়াবহ রকমের চামচামি করেছেন। এজন্য জাতিসংঘের কার্যালয়কে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘চিঠিতে আমরা বলছি, তারা যেন ইনডিপেনডেন্ট (স্বাধীন বিশেষজ্ঞ) এক্সপার্ট নিয়ে এসে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা কীভাবে গত ১৫ বছরে ফেইলিউর হয়েছে, সেটি বের করে। আমরা এই ফেইলিউরগুলো জানতে চাই।’
প্রধান শফিকুল বলেন, ‘হাসিনার কুণ্ডপ্ররোচনায় কীভাবে সাংবাদিকরা মানুষকে জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে তাকে কিলিংয়ের বৈধতা দিয়েছে... এই কাজগুলো কারা করেছে? অনেক ক্ষেত্রে একটা ভালো লোক বা আমি জানি তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তাকে জঙ্গি ট্যাগ করে দিলেন। এটার মানে কি, আমি রাষ্ট্রকে প্ররোচনা দিচ্ছেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, তাকে মেরে ফেলতে। এই কাজগুলো তো হয়েছে। আমাদের জার্নালিজমের ফেইলিওর তো অনেকগুলো ছিল। আপনাদের গণতন্ত্র চলে গেল, তিনটা ভয়াবহ রকমের ভুয়া নির্বাচন হলো। প্রত্যেকটা সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সাংবাদিকদের ভূমিকা কিন্তু সামনে আসে। অনেকেই এখন সুশীল সাজেন। তো এই ফেইলিওরগুলো আমরা জানতে চাই। যে কোথায়-কোথায় জার্নালিজমের ফেইলিওর হয়েছে, সেটা নিয়ে ইউএনকে আমরা চিঠি দেব।’
সাংবাদিকদের ছুটিছাটা-সুবিধা বাড়ানো হবে কি না এই প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর কড়া সমালোচনা করেন প্রায় তিন দশক সাংবাদিকতা পেশায় দায়িত্ব পালন করা শফিকুল। তিনি বলেন, ‘আপনাদের ইউনিয়ন এগুলোর ব্যাপারে বলা উচিত। সরকারই আপনাদের হয়ে সব করে দেবে, এটার চেয়েও আমার মনে হয় ইউনিয়নের এই আলাপটা তোলা উচিত। নেগোসিয়েশনটা হচ্ছে ইউনিয়নের সঙ্গে মালিকদের। কিন্তু আমাদের ইউনিয়ন তো গত ১৫ বছর পূর্বাচলের প্লট নিয়ে ব্যস্ত ছিল, ডিজিএফআইয়ের দালালি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। একটা ঠান্ডা মাথার খুনি মনিরুল, তার সঙ্গে সবাই ছবি দিচ্ছেন, মনিরুল ভাই আপনি না আসলে দেশ উদ্ধার হতো না, এই সমস্ত মেসেজ দিতেন। আমার মনে হয় ইউনিয়নের এই আওয়াজগুলো তোলা উচিত। আমাদের সাংবাদিকদের ভয়াবহ রকমের ঠকানো হয়।’
শফিকুল বলেন, ‘৩০ হাজার টাকার নিচে কোনো সাংবাদিক বেতন পাবে না। আর যারা দিতে পারবে না, তারা আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধ করে দেন। আমাদের ডিএফপির যে সিস্টেম, সর্ষের ভেতরে ভূত। সে জায়গাটায় আওয়াজ তোলা উচিত। সাংবাদিক নেতারা পত্রিকার অনুমোদন নিয়ে ডিএফপির তালিকায় সবার উপরে রেখে দেয়, অথচ একটি কপিও চলে না। নিজে পড়েন, ওনার বউ পড়েন, আর কেউ পড়েন না। এই আওয়াজগুলো ইউনিয়নের তোলা উচিত।’