ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গরিবের কাছে সোনার হরিণ ইলিশ

গরিবের কাছে সোনার হরিণ ইলিশ

কাগজে-কলমে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ ঠিকই; কিন্তু এই মাছের স্বাদ গ্রহণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। ইলিশ এখন ধনীদের বিলাসী খাবারে পরিণত হয়েছে। এখন ধনীদের পাতেই ইলিশের দেখা মিলে। গরিবের কাছে ইলিশ এখন অনেকটা সোনার হরিণ। বড় সাইজের এক হালি ইলিশ কিনতে গুণতে হয় প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, যা নিম্নআয়ের মানুষের কাছে অসাধ্য ব্যাপার। আপাতত, দেশের জাতীয় মাছটির দাম নিয়ে কোনো সুখবর নেই। কারণ, ইলিশের এই উচ্চমূল্য আগামীতেও অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে, দাম নির্ধারণে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে, কিছু এলাকায় আবার ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। নানা অজুহাতে হাঁকা হচ্ছে চড়া দাম।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক কেজি সাইজের প্রতিটি ইলিশের দাম চাওয়া হয় ২ হাজার ৮০০ টাকা। আর ৬০০ গ্রাম সাইজের ইলিশের কেজি ২ হাজার টাকা হাঁকছেন বিক্রেতা। একজন বিক্রেতা বলেন, ‘সকালে আড়তে মাছ পাইনি। ঘাট থেকে এসব মাছ কিনে আনা হয়েছে একটু আগেই।’ হাত দিয়ে দেখিয়ে এই বিক্রেতা বলেন, ‘ওইদিকে একটা দোকানেও ইলিশ নেই। সকালে সবাই আড়ত থেকে ফিরে এসেছে, অনেকে অন্য মাছ বিক্রি করছে।’ আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘ঈদের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি কেজি ইলিশের দাম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা বেশি।’ এই বিক্রেতা এক কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৩ হাজার ২০০ টাকা দাম চান। অর্থাৎ তার প্রতিটি ইলিশের দাম দাঁড়াচ্ছে চার হাজার টাকার কাছাকাছি। একজন ক্রেতা সেখানে ইলিশ ওজন করিয়ে না কিনে ফিরে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এটা (ইলিশ) আমাদের কেনার ক্ষমতার বাইরে। মাঝেমধ্যে পরিবারের আবদারে কিনতে হয়, আর এখন কিছু আত্মীয় ছিল, সেজন্য কিনতে চাইলাম। কিন্তু দাম এত বেশি হলে কেনা সম্ভব কীভাবে?’

ঢাকার আরও কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ চাকা থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা ও ৮০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ প্রতি কেজি ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, ইলিশের মৌসুম এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। এর মধ্যে যা পাওয়া যাচ্ছে তার দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ। মূল্যবৃদ্ধি শুধু সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়, অনেক দিন ধরেই ইলিশের দাম চড়া।

সূত্রমতে, দেশে সারাবছরই ইলিশ ধরা পড়ে। তবে বেশি ধরা পড়ে বর্ষার শেষে। ইলিশ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, মে ও জুন মাস থেকে একটু বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি। তবে জুলাইয়ের প্রথম ভাগে ইলিশের এত বেশি দাম কোনোভাবেই যৌক্তিক না।

এদিকে, ইলিশের দাম সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে উৎস স্থানে দাম বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তবে এরপর ঢাকার বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়েছে। অন্যদিকে ইলিশের মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার খবরে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে ব্যবসায়ীদের মাঝে। ইলিশের মূল্য নির্ধারণ হলে বিক্রি বন্ধের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিক্রেতারা বলছেন, বিষয়টি একেবারে অযৌক্তিক। ইলিশের দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করা একেবারে অসম্ভব। যার কারণে সরকারের এ সিদ্ধান্ত কখনোই বাস্তবায়ন হবে না।

একজন ইলিশ বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানে যে ইলিশ সংকট চলছে, তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। জেলেদের আগ্রাসী ভূমিকাই মূলত আজকের ইলিশ সংকট। জাটকা এবং মা ইলিশ রক্ষার কর্মসূচিতে জেলেদের অসহযোগিতামূলক আচরণই আজকের ইলিশ সংকটের অন্যতম কারণ। এছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ইলিশ উৎপাদনে সংকট তৈরি করছে। ইলিশকে রক্ষা করতে এবং ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সরকার প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। ইলিশ শুধু আমাদের মাছ এবং আমিষের চাহিদাই পূরেণ করে না, ইলিশ রপ্তানি করে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করি। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ। ইলিশের আকাল দূর করে জেলেদের মুখে হাসি ফুটানোও সম্ভব কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। তবে সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে কঠিন কঠোর হতে হবে এবং তার সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। জেলেদেরও সচেতন করতে হবে।

সূত্রমতে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইলিশের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ২০০২ সালে ইলিশ রক্ষার জন্য মা ইলিশ ও জাটকা ধরায় নিষেধাজ্ঞা এবং প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইলিশের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের কারণে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। এতে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। ফলে ইলিশের ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বেশ ভালো কাজ করে। এ ছাড়া চর্বিসংক্রান্ত সব সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। ইলিশে থাকা ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এল-আরজিনিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে, যা মাংসপেশি ও টিস্যু তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই মাছে যে প্রোটিন থাকে, তা কোলাজেন সমৃদ্ধ। কোলাজেন হচ্ছে অদ্রবণীয় প্রোটিন, যা কোষের যোগাযোগক্ষমতা বাড়িয়ে কোষের সার্বিক কার্যকারিতা বাড়ায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত