দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক চলমান রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশের মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে দফায় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় দলগুলো নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে দিয়েছে দলগুলো। তিনি বলেন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের আলোচনায় উচ্চকক্ষের বিষয়ে আগেও কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং জোট দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনে সমর্থন জানিয়েছে। তারা সেভাবেই তাদের মত প্রকাশ করেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছ থেকে এই মতামত পাওয়া গেছে। বলতে পারি বড় আকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনে মত দিয়েছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আলোচনায় দুইভাবে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনা হয়। দলগুলো তাদের কেউ কেউ অবস্থান পরিবর্তন করলেও অনেকেই তাদের আগের অবস্থানে আছেন। একদিকে কেউ কেউ বলছেন ভোটের সংখ্যানুপাতে যেন উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্যদিকে আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসনের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও আছে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো এবং জোটগুলো এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে আসতে পারছেন না, সেহেতু একাধিক দিন উচ্চকক্ষের বিষয়ে আলোচনার পর আজও রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার কমিশনের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে আগামী দিনগুলোতে। আমরা এ বিষয়ে অনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো। কমিশন জোর দিয়ে মনে করে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ঠ পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আমাদের আসতে হবে। আমরা দ্রুত আলাপ আলোচনা করে আগামী সপ্তাহের গোড়ার দিকে আমাদের অবস্থান বলতে পারবো বলে মনে করি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আরও বলেন, রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোর সঙ্গে আজ তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। আমরা দুটি বিষয়ে আলোচনায় অগ্রগতি অর্জন করেছি। তিনটি বিষয়ের মধ্যে ছিল দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট, সংবিধান সংশোধন এবং সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়। তবে সময় স্বল্পতার কারণে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।
এদিকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও উচ্চকক্ষে ১০০ আসনের বিষয়ে বিএনপি রাজি হলেও উচ্চকক্ষের আসন নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে রাজি নয় বিএনপি। দলটি মনে করে, উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন হওয়া উচিত নারী সংরক্ষিত আসনের মতো আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যারা উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবেন তাদের নির্বাচনপদ্ধতির বিষয়ে আমরা বলেছি, সংবিধান অনুসারে বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন যেভাবে নির্বাচিত হয় আসনের ভিত্তিতে, সে অনুসারে নির্বাচনের কথা বলেছি।’ সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে আমাদের দলসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল একমত। তবে এটির ঘটনপ্রক্রিয়া ও পাওয়ার অ্যান্ড ফাংশন কী হবে, সে বিষয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে।’ তিনি বলেন, বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে ইতিমধ্যে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিএনপির মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত করা। সেই উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক একটি উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব রয়েছে তাঁর দলের। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে অনেক দল প্রশ্ন তুলেছে বলেও জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো আর্থিক অবস্থায় থাকা একটি দেশে আরেকটি ব্যয়বহুল নিম্নকক্ষের ‘রেপ্লিকা পার্লামেন্ট’ তৈরি করা কতটা দরকার, তা ভাবা উচিত। সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যেসব মৌলিক ধারা রয়েছে যেমন প্রস্তাবনা ৮, ৪৮, ৫৬ ও ১৪২ নম্বর ধারা—এসব ক্ষেত্রে সংশোধন এলেই তা পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের আগে গণভোটে দিতে হবে। এই ধারা অনুসারে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, ভবিষ্যতে কেউ যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে, সে জন্য তা গণভোট ছাড়া পরিবর্তন করা যাবে না—এমন একটি বিধান সংযুক্ত করা হোক। কমিশন এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, একটি মাত্র দল বা সরকারের একক সিদ্ধান্তে সংবিধান সংশোধনের বিপক্ষে তার দল। এর জন্য দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি থাকতে হবে। বিরোধী দলেরও মতামত নিতে হবে। আর মৌলিক বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট হতে হবে এবং এটি যেন রাষ্ট্রের জন্য হয়। ডা. তাহের বলেন, কিছু সংখ্যক দল ছাড়া আমরা বেশিরভাগই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়ে একমত। তবে এক্ষেত্রে পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে সংসদে নারী আসন ১০০ করার পক্ষেও মত দিয়েছে জামায়াত। তবে সেখানেও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে বলে তিনি জানান।
বৈঠকে কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।