ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

থমথমে গোপালগঞ্জ

থমথমে গোপালগঞ্জ

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ও সভায় হামলা চালায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। তারা পুলিশের গাড়ি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ভাঙচুর, অগি?সংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। হামলাকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে চারজন নিহত, ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এলাকায় রণক্ষেত্রে পরিণত হওযায় ১৪৪ ধারার পর গত বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে প্রশাসন। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে আবারও কারফিউ জারি করা হয়েছে। আজ শুক্রবার দুপুর ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। ২টা থেকে আবারও কারফিউ বলবৎ থাকবে। গোপালগঞ্জে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কারফিউ জারি করায় শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে কারফিউইয়ের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কারফিউ চলাকালীন জনসাধারণের চলাচল সীমিত এবং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কারফিউয়ের মধ্যে যৌথবাহিনী বুধবার রাতে অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে আটক করেছে। তাদের গোপালগঞ্জ সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়। কারফিউয়ে জেলায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। সীমিত আকারে রিকশা চলাচল করলেও অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়নি, বন্ধ ছিল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হয়নি। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারে মানুষের আনাগোনা নেই বললেও চলে।

গোপালগঞ্জের বাসিন্দা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘সংঘর্ষের সময় ঘরেই ছিলাম। আমার মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে, সঙ্গে তার মা আছে। সংঘর্ষের কারণে বুধবার খাবার নিয়ে যেতেও পারিনি। তাই গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকাল সকাল বের হয়ে হাসপাতালে খাবার নিয়ে যাচ্ছি। বেলা বাড়ার পর পরিস্থিতি আবারও খারাপ হয় কি-না সেই চিন্তা করে সকালেই রওনা দিয়েছি।’

মাহফুজ আলম নামে এক অটোরিকশা চালক বলেন, কারফিউ জারি হয়েছে। তাই গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। রাস্তাঘাটেও মানুষজন তেমন নেই। অভ্যন্তরীণ রুটের গাড়িগুলোও ছাড়েনি। তবে ঢাকাসহ দূরপাল্লার গাড়িগুলো কিছু চলেছে। সংঘর্ষের পর থেকে ভয়ে আছি।

এদিকে গোপালগঞ্জ সদর সার্কেল পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গোপালগঞ্জ শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে। তবে থমথমে। এনসিপির পথসভার আগে বিভিন্ন উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জ শহরে এসেছিলেন। ছোট ছোট দলে তারা অবস্থান নিয়েছিলেন বিভিন্ন অলিগলিতে। পুলিশের গাড়িতে আগুন ও বেলা সাড়ে ১১টায় ইউএনওর গাড়িতে হামলার খবর আসে। তবে তখনও পৌর উন্মুক্ত মঞ্চের পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ পর জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সভামঞ্চের চেয়ার ও সাউন্ডবক্স ভাঙচুর করে। এ সময় পুলিশ ও স্থানীয় এনসিপির নেতাকর্মীরা পাশের কোর্ট চত্বরে গিয়ে আশ্রয় নেন।

পুলিশ ও র‌্যাবের পাহারায় এনসিপির নেতাদের শহর থেকে বাইরে বের করার চেষ্টা করা হলেও ব্যাপক হামলার মুখে তাদের আবারও শহরে ফিরিয়ে আনা হয়। কিছুক্ষণ পরে সেনাবাহিনীর একটি টহল টিম ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপরেও হামলা চালানো হয়। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোঁড়েন বলে জানা যায়। সেনাবাহিনী ও পুলিশের কড়া পাহারায় এনসিপির নেতারা গোপালগঞ্জ ছাড়েন। জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে গোপালগঞ্জে এত বড় ঘটনা ঘটবে, এ ধরনের আগাম কোনো তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে না থাকার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এ অবস্থায় বুধবারের পরিস্থিতি নিয়ে আগাম কোনো তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে ছিল কি না, প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।

জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘গোয়েন্দাদের তথ্য ছিল, তবে এতো পরিমাণ যে হবে ওই তথ্য ছিল না।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে না পারার অভিযোগ করেছেন এনসিপি নেতারা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটাতো আপনিও দিতে পারেন, যার যার বক্তব্য সে সে দিবে।’ অপর এক প্রশে?র জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সেখানে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। এ ব্যাপারে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি এখন শান্ত। গোপালগঞ্জের ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করা না হলে এনসিপি ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি দেওয়ার কথা বলছে। এ ব্যাপারে এক প্রশে?র জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা অন্যায় করেছে, তারা গ্রেপ্তার হবে।’ তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিডায় আয়োজিত এক কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা সন্তোষজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো আমার মতে আমি যতটুকু দেখেছি ভালো ভূমিকা পালন করেছে এবং তারা সফলভাবে’ সেখান থেকে প্রত্যেককে ইভাকুয়েট করতে পেরেছে। আশা করছি, আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লিডারশিপে- যারা এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, অস্ত্রশস্ত্রসহ হামলা করেছে- তাদের তারা গ্রেপ্তার করবে। গোপালগঞ্জের সহিংসতার বিষয়ে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সারাদেশ থেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসীরা সেখানে (গোপালগঞ্জ) গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে এবং গতকালকে একটা ন্যাক্করজনক ঘটনা সেখানে ঘটেছে। এটা আমরা কখনোই প্রত্যাশা করি না। আমরা চাই যে শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়, শান্তিপূর্ণভাবেই সবকিছু রাজনৈতিক কার্যক্রম চলবে। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

তদন্ত কমিটি গঠন : গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। এই কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি। কমিটিতে তার সঙ্গে আরও থাকবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের একজন করে অতিরিক্ত সচিব। কমিটিকে ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দুই সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার আবারও তার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছে এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও যে কেউ যে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড, সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের আইনের আওতায় এনে জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।

আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি : সম্প্রতি গোপালগঞ্জে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জনসাধারণকে ধৈর্য ধারণ ও সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে সেনাবাহিনী বলছে, একটি রাজনৈতিক দলের জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে আহ্বান করা জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে এলাকার একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা গত বুধবার সংঘবদ্ধভাবে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এদিন একপর্যায়ে আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী। গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেনাবাহিনীর বক্তব্যে বলা হয়, ‘ওইদিনের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিক আহত হন। এছাড়াও, শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সরকারি যানবাহনে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে হস্তক্ষেপ করে এবং প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।’ ‘ওই রাজনৈতিক সংগঠনের সমাবেশ চলাকালে মঞ্চে আবারও হামলা চালানো হয় এবং একইসঙ্গে জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এমন অবস্থায়, সেনাবাহিনী হামলাকারীদের মাইকে বারবার ঘোষণা দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। তারা সে আহ্বান না শুনে সেনাবাহিনীর ওপর বিপুল সংখ্যক ককটেল ও ইটপাটকেল ছুড়ে হামলা করে।

একপর্যায়ে সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বল প্রয়োগে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময়ে, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে বিশৃঙ্খলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের খুলনায় স্থানান্তর করা হয়। সর্বোপরি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পেশাদারত্ব ও ধৈর্যের সঙ্গে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।’ বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলায় সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং প্রশাসনের জারি করা কারফিউ চলমান রয়েছে উল্লেখ করে সেনাবাহিনী বলছে, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব এবং প্রশাসনের অন্যান্য সংস্থা ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় রেখে কাজ করে যাচ্ছে। বুধবার সকাল থেকে চলমান এই রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলায় গোপালগঞ্জ জেলার জনসাধারণ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে নিজেদের নিবৃত্ত রেখে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন। গুজব বা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে ধৈর্য ধারণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব ও জননিরাপত্তা রক্ষায় সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত