
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতাদের হাত ধরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই দলের শীর্ষ নেতারা রাজপথে নেতৃত্ব দিয়ে কোটা সংস্কার বাস্তবায়ন ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের রাজত্ব চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। দলটি রাজপথ থেকে জাতীয় সংসদে যেতে চায়, সেজন্য সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের জনসংযোগ, মিছিল ও পথসভা করছে এনসিপি। তাদের লক্ষ্য দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক হিসেবে নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছে দলটি, নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে চেয়েছে ‘শাপলা’।
জানা গেছে, ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এনসিপি দলীয় অবস্থানের জানান দিতে জনগণের দোরগোড়ায় যাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, মুন্সিগঞ্জ, নড়াইল, খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় পথসভা করছে এনসিপি। প্রতিটি পথসভায় ব্যাপক সাড়া পেয়েছে দলটি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বড় সাফল্যের পর রাজপথই বেছে নিয়েছেন তরুণ নেতারা। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে চায়। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষায় রাজনীতির অগ্রাধিকার দিয়েছে। সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদ- প্রতিষ্ঠিত এবং রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অবসান ঘটাতে চায় এনসিপি। এনসিপির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কার্যক্রম, সরকারের কাছে দাবি, জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোসহ বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।
এনসিপির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ভাবছে এনসিপি। দলটিতে তারুণ্যের অগ্রাধিকার থাকলেও মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্র সাংগঠনিক দক্ষতা, জনপ্রিয়তাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। দলটিতে যোগ দেওয়ার জন্য অনেকেই যোগাযোগ করছেন। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করবে।
সম্প্রতি নড়াইলে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’য় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, এনসিপি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজপথ থেকে গড়ে ওঠা তরুণদের নেতৃত্বে একটি দল। গত বছর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এদেশের ছাত্র-তরুণ-জনতা রাজপথে নেমেছিল। নতুন দল করা আমাদের লক্ষ্য ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল এই দেশটাকে পুনর্গঠন করা। এই দেশটাকে ভালোমতো তৈরি করা। বিদ্যমান যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, যদি তাদের নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠন হওয়া সম্ভব হতো, তাহলে হয়ত আমাদের দল করার প্রয়োজনই হতো না। তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে ৭-৮ মাস দেখেছি, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে ক্ষমতার জন্য আসন ভাগবাটোয়ারার জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। একটা গণঅভ্যুত্থানকে তারা গণঅভ্যুত্থান হিসেবে স্বীকার করতে চায় না। তারা মনে করে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্যই এই গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। এক বছরও যখন আমরা পাইনি সেই আমাদের আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ, ফলে আমরা রাস্তায় নেমেছি আবার। নতুন দেশ গড়ার আহ্বান নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা বলেছি গণহত্যার বিচার, দেশের মৌলিক সংস্কার এবং নতুন সংবিধান লাগবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা সেই ৩টির কোনো একটি সম্পূর্ণভাবে আদায় করতে পারিনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিচার সংস্কার এবং নতুন সংবিধানের চেয়ে নির্বাচন নিয়ে বেশি তড়িঘড়ি করছে। কিন্তু আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, নির্বাচন আমরাও চাই। বিচার, সংস্কার এবং নতুন সংবিধানের মাধ্যমে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা স্বপ্ন দেখে আগামী বাংলাদেশ নতুন এক সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে। সেই স্বপ্ন নিয়ে এনসিপি সামনের দিকে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি বন্দর নগরী চট্টগ্রামে চকবাজার অলি খাঁ মসজিদের সামনে এক পথসভায় এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আগামী নির্বাচনে ভোটারদের মার্কা দেখে নয় বরং যোগ্য প্রার্থী দেখে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। এনসিপির প্রার্থীকে যোগ্য মনে না হলে ভোট দেওয়ার দরকার নেই। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, দেশের মানুষের জন্য, দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা আপনাদের কাছে নেমে এসেছি। আমাদের নিজেদের স্বচ্ছ ইনকাম সোর্স রয়েছে। রাজনীতি করে, টেন্ডারবাজি করে আমাদের চলাফেরার করার কোনো প্রয়োজন নাই। আপনারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব থাকবেন। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করবেন এবং যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। গত বছর নির্বাচনে একটা ভোটের দাম কত ছিল? দুই হাজার? এবার কত করে নিবেন? তিনি বলেন, আমাদের দেশের নেতারা রাস্তার টাকা খেয়ে ফেলে, টেন্ডারবাজি করে, গরীবের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। আর আমাদের দেশের ভোটাররা ভোট বিক্রি করে দেয়। আমাদের দেশের ভোটাররা আগের রাতের ভোট বিক্রি করে দেয়। আপনার যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের পূর্বে আগে নিজে যোগ্য ভোটার হওয়া উচিত। আমরা কি টাকার বিনিময়ে ভোট বিক্রি করব? জনগণের কাছে এনসিপির প্রতি সহযোগিতা চেয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আগামী নির্বাচনে যে দলের প্রার্থীকে আপনারা যোগ্য পাবেন, হক-হালালের পথে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও ছাত্র-জনতার পক্ষে পাবেন, তাদের পক্ষে এসে দাঁড়ান। টাকা দেখে নেতা নির্বাচন করবেন না। যে নেতা টাকা দিয়ে ভোট কিনতে আসে, সে এই ভোটের টাকা আগামী ৫ বছর ধরে তুলবে। আপনি একরাতে একটা ভোট বিক্রি করবেন আর সে নেতা তার আসনের দুই-তিন লাখ মানুষের হক ৫ বছর ধরে নষ্ট করবে। আমরা বেঁচে থাকতে, আমাদের গায়ে এক বিন্দু রক্ত থাকতে, এই দেশে আর আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হবে না। এই দেশে হাসিনার পুনর্বাসন হবে না। আওয়ামী রক্ত আছে এমন কারো পুনর্বাসন হবে না। আওয়ামী সংবিধানকে চিরদিনের মত এই বাংলাদেশে আমরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করব। নতুন সংবিধানের জন্য আমরা লড়াই করব।
গতকাল রোববার জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে রাঙ্গামাটিতে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, বাংলাদেশে জাতি-গোত্রের কোনো বিভাজন চলবে না। আমরা পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশে কোনো জাতি-গোত্রের মধ্যে বিভাজন করা চলবে না। এদেশে তারাই রাজনীতি করতে পারবে, যারা প্রত্যেক জাতি ও মানুষের কথা বলতে পারবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আজকের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উপস্থিত হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশে যতগুলো জাতিগোষ্ঠী আছে সবার মধ্যে একটা বিভাজন ঘটিয়ে গত ৫৩ বছর ধরে শাসন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এই দেশের নাগরিকদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ সংবিধান পাইনি। প্রত্যেক নাগরিকের পরিচয়পূর্ণ সংবিধান আমরা পাইনি। এই রাঙ্গামাটির মানুষ গণঅভ্যুত্থানের সময় রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন করতে চাই, তাদের নিরাপত্তা কোথায়? সামান্তা শারমিন আরও বলেন, বাংলাদেশ হবে সম্মান ও মানবিক মর্যাদার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ। এখানে আমরা কখনও জাতিভেদ করব না, কখনও গোষ্ঠী ভেদ করব না। এখানে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ ও প্রত্যেক জাতির মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। মর্যাদা নিয়ে বসবাস করবে- এটাই আমাদের লক্ষ্য।