বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেছেন, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে কোনো আপস করে না। বিধ্বস্ত বিমানটি পুরোনো নয় বলেও দাবি করেছেন তিনি।
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন কথা বলেছেন।
এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন, সোমবার দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে আমাদের যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় বিধ্বস্ত হয়েছে রানওয়ের নিকটে। ক্র্যাশ সাইটটা ছিল মাইলস্টোন স্কুলের একটা বিল্ডিং যেখানে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রী এবং শিশুসহ শিক্ষক এবং অনেকে নিহত হয়েছেন।
যারা ওখানে ছিল তাদের আমরা যত দ্রুত সম্ভব উদ্ধার করে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে এবং ফাস্ট রেসপন্ডার হিসেবে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর উদ্ধারকর্মীরা গিয়েছিল। ফায়ার ব্রিগেডও তাতে রেসপন্ড করেছিল এবং আমরা যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি, বলেন তিনি।
বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, বিমানটা যখন পাইলটের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন বিমানটাকে খালি জায়গায়, বিশেষ করে ওই মাঠটাই পেয়েছিল যেখানে তিনি নামানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও তার শেষ চেষ্টা সফল হয়নি।
তিনি বলেন, বিমানটা আছড়ে পড়েছিল ওই বিল্ডিংয়ের উপরে। কিন্তু তিনি নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যে বা বিমানটাকে সঠিক দিক নির্দেশনায় যাওয়ার জন্য যে মূল্যবান সময় দিয়েছেন, তার জন্যে ইজেকশন বা বিমান থেকে বের হওয়ার সময় বিলম্বিত হয়ে যায় এবং তিনি তার নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।
তিনি আরও বলেন, সোমবার থেকেই দেশের এই বিপদের সময় আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টারা, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, চিকিৎসকবৃন্দ, ফায়ারসার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবী, বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থা, সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ জনগণ কাঁধে কাধ মিলিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, ইতোমধ্যে গতকাল আমরা একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম গঠন করে দিয়েছি। তারা অতি শিগগির তদন্ত করে বের করবে যে কী ঘটনা ঘটেছিল এবং তার ভিত্তিতে যদি কোনো ভুলত্রুটি থাকে, অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
তিনি বলেন, আমি বিশেষ অনুরোধ করতে চাই দয়া করে আপনারা দেশের এই বিপদের সময় সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন গুজব-মিসইনফরমেশনে কান দেবেন না। আমি সফরে বেরিয়েছিলাম, জরুরি সফর ছিল। কিন্তু আমি বিমানবন্দর থেকেই সরাসরি ফিরে এসেছি আজ সকালে।
প্রতিদিন যখনই আমাদের কাছে কোনো আপডেট আসে, আহত-নিহত সেটা আমরা সাথে সাথে আইএসপিআরের মাধ্যমে আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি। এখানে লুকানোর বা গোপন করার কোনো বিষয় নেই, বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন, যুদ্ধবিমান সাধারণত সহজে পুরোনো হয় না। প্রতিটি বিমানের একটা লাইফ লাইফটাইম আছে। এই বিমানগুলোর প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত লাইফ সাইকেল থাকে। এক যুগ দুই যুগ না, ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা এটাকে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি কিনা। আমি আশ্বস্ত করতে চাই যে বিমানের ক্ষেত্রে আমরা কোনো কম্প্রোমাইজ করি না রক্ষণাবেক্ষণে। আমরা যে দেশ থেকে বিমান ক্রয় করি সে দেশ থেকে আমরা রক্ষণাবেক্ষণের সব প্রযুক্তি এবং দরকার হলে যা যা প্রয়োজন হয় সেটাও আমরা তাদের সঙ্গে চুক্তি করে নিই। প্রযুক্তিগতভাবে এই বিমানগুলো পুরোনো হয়েছে, কিন্তু এই বিমান পুরোনো না। এখন আমরা নতুন প্রযুক্তির বিমানের জন্য অবশ্যই চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির বিমান আনব। তার মানে এই না যে ওটাও অ্যাক্সিডেন্ট হবে না। আসল কথা হলো আমরা এই বিমানগুলো যথাসম্ভব ভালোভাবে মেরামত করি। যা যা মেইনটেন্যান্স প্রয়োজন, সেগুলো করি, বলেন তিনি।
দুর্ঘটনা বিষয়ক আরেক প্রশ্নের জবাবে বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, তদন্তের আগে কোনো ধারণার কথা বলা ঠিক হবে না। তবে এটা একটা সিঙ্গেল ইঞ্জিন বিমান। ইঞ্জিনের অনেক টেকনিক্যাল প্রবলেম হতে পারে—পাখির আঘাত হতে পারে, অন্য কিছু হতে পারে। তদন্ত করতে একটু সময় লাগবে আপনাদের ধৈর্য ধরতে হবে।
তিনি বলেন, প্লেনের যত ঘণ্টা থাকার কথা, ওই ইঞ্জিনের তত ঘণ্টার এক ঘণ্টাও বেশি আমরা ফ্লাই করি না। এটার যা যা রিপেয়ার করার কথা, সেটা আমরা সম্পূর্ণভাবে করি। কিন্তু বিকল যখন হবে সেটা বলে কয়ে হয় না। সেটা কখন হবে সেটা আমরা বলতে পারি না।
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এমন জায়গা খুঁজে বের করলেও পাশে আবার ঘনবসতি হয়। এখানে যখন বিমানবন্দর হয়েছিল আমি যখন প্রথম এখানে ১৯৮৫ সালে ফ্লাই করেছিলাম তখন এই ওদিকে কিছুই ছিল না, উত্তরা বলতে কিছু ছিল না। এটার সঙ্গে ঘনবসতির সম্পর্ক করা ঠিক না। আমাদের দেশ ছোট, সব জায়গায় মানুষ। এটা (কুর্মিটোলা) আমাদের মেইন বেইজ, সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট জায়গা এটা। ভিআইপিরা এখানে থাকে, আমাদের স্থাপনা এখানে, পার্লামেন্ট এখানে। একটা প্রটেকশনের ব্যাপার আছে এখানে একটা স্ট্রং এয়ারবেজ থাকা খুবই দরকার।
বিধ্বস্ত বিমানটি প্রশিক্ষণ নয়, ছিল যুদ্ধবিমান- আইএসপিআর : রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে প্রশিক্ষণ বিমান নয়; বরং যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। গতকাল মঙ্গলবার এক বার্তায় বিষয়টি স্পষ্ট করেছে আইএসপিআর। ওই বার্তায় বলা হয়, মাইলস্টোনের ঘটনায় কিছু সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে, বিমানটি একটি প্রশিক্ষণ বিমান ছিল। আমরা বিনীতভাবে আবারও জানাতে চাই, এটি ছিল যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী একটি যুদ্ধবিমান। বিমানটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল।
আইএসপিআর জানিয়েছে, গত সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে রাজধানীর কুর্মিটোলার বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি স্কুল চত্বরের একটি দোতলা ভবনের ওপর এসে বিধ্বস্ত হয়। প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত চীনের তৈরি এ যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উত্তরার ওই স্কুল ভবনে আছড়ে পড়েছিল। সকালে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৭ জন। আহত ১৭১ জন। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৭৮ জন। সোমবার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই আগুন ধরে যায় স্কুল ভবনে। তখন দগ্ধ শিশুদের আর্তনাদ, সন্তানের খোঁজে পাগলপ্রায় মা-বাবা ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ।
মাইলস্টোনে উদ্ধারকাজের সময় ‘অনভিপ্রেত’ ঘটনার তদন্ত শুরু- আইএসপিআর : রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গতকাল যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর উদ্ধারকাজের সময় ‘অনভিপ্রেত’ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে সেনাবাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এ তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়, দুর্ঘটনার পরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিকটবর্তী ক্যাম্প থেকে সদস্যরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন। ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বিতভাবে আহতদের দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করতে তৎপরতা চালানো হয়।
আইএসপিআর বলছে, উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালে দুর্ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ব্যাপক ভিড় দেখা দেয়, যা ইভাকুয়েশন ও রেসকিউ কার্যক্রমকে বারবার ব্যাহত করে। সেনাসদস্য ও মাইলস্টোন স্কুলের স্বেচ্ছাসেবকরা বারবার অনুরোধ করলেও অনেক মানুষ ঘটনাস্থল ত্যাগ না করায় সময়মতো আহতদের সরিয়ে নেওয়া অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এতে, প্রাণহানির ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায় বলে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, সেনাসদস্যরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই উদ্ধার কার্যক্রমে নিয়োজিত ১৪ জন সেনাসদস্য শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে বর্তমানে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন আছেন।
উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালে বিকালের দিকে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কিছু উৎসুক জনতা ঘটনাস্থল ত্যাগ না করায় উদ্ধারকাজে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ফলে, একদল উৎসুক জনতার সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়, যা এক পর্যায়ে একটি অনভিপ্রেত ঘটনার অবতারণা করে বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।