বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই সংঘর্ষে হতাহত কয়েক হাজার ব্যক্তিকে নেওয়া হয়েছিল রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। তাদের মধ্যে নারী, শিশুসহ সব বয়সী মানুষ ছিলেন। অধিকাংশ ছিলেন গুলিবিদ্ধ। ছররা এবং বুলেট দুই ধরনের গুলিই ছিল আহতদের শরীরে। নিহত ব্যক্তিদের বড় অংশই ছিলেন বুলেটবিদ্ধ।
ওই সময়ে হাসপাতালের সূত্র জানা যায়, হতাহতদের তথ্য পেতে রোগী ভর্তি এবং মৃত্যুর নিবন্ধন খতিয়ে দেখে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। এতে আতঙ্কিত ছিলেন চিকিৎসাধীন ব্যক্তি ও তাদের স্বজন। ঝামেলা এড়াতে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আহতদের ছাড়পত্র দিয়ে ‘বিদায় দেয়’। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-শনিরআখড়া, উত্তরা-আবদুল্লাহপুর, রামপুরা-বাড্ডা এবং মোহাম্মদপুর-বছিলা এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এসব এলাকার আশপাশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই তিন দিনে প্রায় ৪ হাজার ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল পুলিশ ও আনসার সদস্যকেও। তবে তাদের কেউ গুলিবিদ্ধ ছিলেন না।
ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ নিহতের সংখ্যা অজানা: রাজধানীতে সংঘর্ষে কতজনের প্রাণ গেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সর্বোচ্চ ৮৯ লাশের ময়নাতদন্ত করেছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ। বাড্ডার এএমজেড হাসপাতালে ২৩, রামপুরার ফরাজী হাসপাতালে ১৫, সোহরাওয়ার্দীতে ১৩, কুয়েত মৈত্রীতে ছয়, উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে ছয় ও নিউরোসায়েন্সেসে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর ১৩ জনের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। হাসপাতালটির পরিচালক ডা. শফিউর রহমান বলেছিলেন, উপায় না থাকায় ময়নাতদন্ত করা যায়নি। অন্য হাসপাতালে নিহতদের ময়নাতদন্ত করতে সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত নয়। ঘটনাস্থলে নিহত কয়েকজনের মরদেহ হাসপাতালে না নেওয়ার তথ্য জানা গেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। ফলে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা অজানা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিহতের তালিকা করছিল বলে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কূটনীতিকদের জানিয়েছিলেন।
সরকারি হাসপাতালে হাজারের বেশি আহত: সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে ১৮ জুলাই থেকে পরের ছয় দিনে ১ হাজার ৭৩ আহত ব্যক্তি ভর্তি হয়েছিলেন। পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে হাসপাতালটিতে সংঘর্ষে আহত ১ হাজার ২৬৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৪১ জন গুলিবিদ্ধ। সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংঘর্ষে আহত ৫১৮ জন চিকিৎসা নেন। কুয়েত মৈত্রীতে চার শতাধিক আহত চিকিৎসা নেন। আরেক সরকারি হাসপাতাল মিটফোর্ডে আহত ৫১ জন চিকিৎসা নেন। অন্য দুই সরকারি হাসপাতাল মুগদা এবং কুর্মিটোলার তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০২৪ সালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১৭ থেকে ২২ জুলাই ছয় দিনে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৪ জন। এর মধ্যে চোখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ২৭৮ জনের। তাদের চোখে ছররা গুলির আঘাত ছিল বলে জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রামপুরা-বাড্ডার দুই হাসপাতালে ১৮০০ আহত : সংঘর্ষের তিন দিনে সংঘর্ষপ্রবণ রামপুরার ফরাজী হাসপাতাল এবং বাড্ডার এএমজেড হাসপাতালে আসেন ১ হাজার ৮০০ ব্যক্তি। তাদের ৯০ শতাংশই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী এলাকায় আহতদের অন্য হাসপাতালেও নেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া ফরাজী হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছিলেন, ১৮ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টায় সময় গুলিবিদ্ধ এক মাইক্রোবাস চালককে মৃত অবস্থায় আনা হয়। এরপর শুরু হয় আহতদের ঢল। ওই সময় হাসপাতালে চিকিৎসক ছিলেন একজন। ছিলেন দুইজন স্বাস্থ্যকর্মী। পরিস্থিতি সামাল দিতে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর ৩০ জনের একটি টিম করা হয়। ফরাজী হাসপাতালে শুধু দেওয়া হয় প্রাথমিক চিকিৎসা। গুরুতর আহতদের সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। কারও পায়ে, কারও হাতে বা কারও বুকে গুলির আঘাত ছিল। আহত ২২ পুলিশ সদস্যের কেউ গুলিবিদ্ধ ছিলেন না। ফরাজী হাসপাতালের উপমহাব্যবস্থাপক রুবেল হোসাইন ওই সময়ে বলেছিলেন, ১৮ জুলাই থেকে তিন দিনে ৯৫০ জনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। যাদের ৯০ শতাংশ ছিলেন গুলিবিদ্ধ। শিশু থেকে সব বয়সী আহতরা এসেছিল। ওই তিন দিনে ফরাজী হাসপাতালে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। উত্তর বাড্ডায় এএমজেড হাসপাতালে ১৯ এবং ২০ জুলাই প্রায় ৮৫০ আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন। এখানে ২৩ জনের মৃত্যু হয়। জরুরি বিভাগের রোগী নিবন্ধন খাতা দেখতে চাইলে দেখাতে রাজি হয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এএমজেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আরমান বলেছিলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৮ ও ১৯ জুলাই আসা আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এত আহত ব্যক্তির ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আমাদের নেই। আহত অনেকের হাতে, কারও বুকে আবার কারও গায়ে গুলি লেগেছিল। অনেককে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। এএমজেড হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ইমরান হোসেন বলেছিলেন, কে কোন এলাকা থেকে আহত হয়ে এসেছেন কিংবা মৃতদের তথ্য আলাদা করে রাখা হয়নি। তথ্য সংগ্রহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এসেছিলেন। তাদের এ কথাই বলছি। এএমজেড হাসপাতালের উল্টো পাশে বাড্ডা জেনারেল হাসপাতাল। আগের দু’দিন বন্ধ রাখলেও গত ২০ জুলাই শিক্ষার্থীদের চাপে আহতদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) অবিনাশ মৃধা বলেন, ওই দিন আহত হয়ে ৫০ থেকে ৬০ ব্যক্তি এসেছিলেন। পাশের ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টারে জরুরি বিভাগ নেই। আহতদের চিকিৎসা না দেওয়ায় ভাঙচুর করা হয় হাসপাতালটি। পরে একটি জরুরি টিম করে শতাধিক আহতকে চিকিৎসা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন চিকিৎসক। রামপুরার বেটার লাইফ হাসপাতালে ১৭ জুলাই থেকে পরের চার দিনে প্রায় ৫০০ জন আহতকে চিকিৎসা দেওয়া হয়, যাদের অধিকাংশ ছিলেন গুলিবিদ্ধ। হাসপাতালটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ১৭ এবং ১৮ জুলাই চিকিৎসার জন্য আসা আহতদের বড় অংশ ছিলেন শিক্ষার্থী। পরের দুই দিন আসেন সাধারণ মানুষ। তারা শিক্ষার্থীদের মতো ছররা নয়, বুলেটবিদ্ধ ছিলেন। কমপক্ষে চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। বনশ্রীর ফেমাস স্পেশালাইজড হাসপাতালে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার পর ১২ জন বুলেটবিদ্ধ রোগী হন। তাদের ৯ জনের পায়ে, তিনজনের গায়ে এবং একজনের মাথায় গুলি লেগেছিল। ২০ জুলাই বনশ্রীর আল রাজী ইসলামিয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ১৫ জনই ছিলেন বুলেটবিদ্ধ। তবে এসব বেসরকারি হাসপাতাল বুলেটবিদ্ধদের ভর্তি করেনি। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠায় সরকারি হাসপাতালে।
মোহাম্মদপুর-বছিলা থেকে নৌকায় হাসপাতালে : ১৯ থেকে ২১ জুলাই তিন দিনের সংঘর্ষে মোহাম্মদপুর ও বছিলায় সংঘর্ষে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা। বছিলা ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিংয়ে ওষুধের দোকানে গুলিবিদ্ধ ৬ জন চিকিৎসা নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা জানান, বেড়িবাঁধ সড়ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় ১৮ জন আহতকে বুড়িগঙ্গা নদীপথে নৌকায় হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে ওই হাসপাতালে আহত রোগী পাওয়া যায়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৫ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ১৫ জনই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। বছিলার মা ও শিশু হাসপাতাল সংঘর্ষের সময় থেকে এখনও বন্ধ আছে। আর আশপাশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কিছু আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন। মোহাম্মদপুরে সংঘাতে আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসা নেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং পঙ্গুতে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, ১৯ ও ২০ জুলাই হাসপাতালটিতে ৪৭২ জন গুলিবিদ্ধ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর পরের দিনগুলোর তথ্য নেই। পঙ্গু হাসপাতালে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পরিবহন শ্রমিক আব্দুল হালিম চিকিৎসা নেয়। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার রাতে হেঁটে বাসায় যাচ্ছিলেন। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। মোহাম্মদপুর ও বছিলার চারজন মারা গেছেন বলে শুনেছেন। ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিং এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে দিনমজুর মো. হাবিব সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। হাবিব বলেন, পেটে ও পিঠে ২১২টি ছররা গুলি লেগেছে।
আহতদের পরিচয় প্রকাশে ভয়: গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি অনেকেই পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি। তাদের শঙ্কা, এতে ঝামেলায় পড়তে পারেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আহত ব্যক্তি জানান, পুলিশের কারণে নদীপথে সিকদার মেডিকেলে গেছেন। আবার কাউকে কাউকে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া এলাকায় গুলিতে আহত অনেকেই আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে নিরাপত্তার শঙ্কায় তারা পরিচয় প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি।
ঝামেলা এড়াতে ছাড়পত্র : কদমতলী থানার পাশেই ইসলামিয়া হাসপাতালের দুটি শাখার একটির মেসেঞ্জার অপারেটর রুবেল বলেন, সংঘর্ষের দিন কয়েকজন আহত ব্যক্তি এসেছিলেন। কাউকে ভর্তি করা হয়নি। অপর শাখাটির পাশেই পুলিশের থানা। এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশি ঝামেলা হতে পারে, সে শঙ্কায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আহতদের অন্য হাসপাতালে যেতে অনুরোধ করা হয়। বেসরকারি স্পেশলাইজড সালমান হাসপাতালের ম্যানেজার গোলাম রাব?ী জানান, প্রায় ৩০০ রোগী এসেছিলেন। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। দু-একজনকে ভর্তি করা হয়। অনেককে ঢাকা, মুগদা ও মিটফোর্ড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কাজলা ফুট ওভারব্রিজের পাশে থাকা অনাবিল হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপক সাগর জানান, কিছু রোগী এসেছিলেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেই সংখ্যা ওই ক’দিনে ৫০ থেকে ৬০ জন হতে পারে।
উত্তরায় হাজারের বেশি আহত: ২০২৪ সালে ১৮ থেকে ২০ জুলাই এই তিন দিনে উত্তরার কুয়েত মৈত্রী, আধুনিক এবং ক্রিসেন্ট হাসপাতালে হাজারের বেশি আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নেন। মৈত্রী হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, সরকারি সংস্থা তথ্য নিয়েছে। গণমাধ্যমকে তথ্য দিতে বারণ রয়েছে।