ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

‘আয়নার মতো স্বচ্ছ’ নির্বাচন করতে চান সিইসি

‘আয়নার মতো স্বচ্ছ’ নির্বাচন করতে চান সিইসি

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভালো করার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, আইন সংস্কার, ভোটার ও দলের নিবন্ধন, আচরণবিধি খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এখন প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা- দুটিই নিশ্চিত হলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব বলে মনে করছেন ইসির সংশ্লিষ্টরা।

নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব ও নানা ইস্যুতে গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করেন ইসির প্রতিনিধিরা। সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশে প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি নেওয়া এবং সরাসরি সম্প্রচার ও স্বল্প সময় অবস্থানে কড়াকড়ি আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে করা হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সঙ্গে সমন্বয় রেখে সাংবাদিকদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্যও এমন বিধান রাখা হয়েছে।

ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশ অবাধ করার পাশাপাশি সরাসরি সম্প্রচার ও ১০ মিনিটের বেশি অবস্থানের সুযোগ রেখে বিদ্যমান সাংবাদিক নীতিমালা সংশোধনের দাবি তোলে টিভি মিডিয়ার প্রতিনিধিরা। সিইসি বলেন, ‘আপনারা আমাদের ভুল বুঝবেন না। এটা শুধু আরপিও লিগ্যাল রিকোয়ারমেন্ট। এটা শুধু ইনফর্ম করার ব্যাপার। প্র্যাকটিক্যাল কারণে এটা করা হয়েছে। আইনটাকে অনার করার জন্য করা হয়েছে। আমাদের নিয়ত পরিষ্কার। ৃগণমাধ্যম আমাদের সোর্স অব ইনফরমেশন।’

গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না, আস্থা সংকট দূর করুন: ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক লোটন একরাম বলেন, ভোটের সময় গণমাধ্যমের জন্য প্রণীত নীতিমালা সংশোধেন করতে হবে। অনিয়ম হলেও কেন্দ্রের ভেতরে সরাসরি সম্প্রচারে মানা, ১০ মিনিটের অবস্থান করার বিষয়টি স্বচ্ছ নির্বাচনে বাধা হবে। বিদ্যমান আইন পরিস্থিতিতে সবার জন্য সুযোগ তৈরি করা ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি। ‘সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ ভাবা হলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে সহায়তার বিকল্প নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর অনিয়মের বিষয়গুলো আমলে না নিলে নির্বাচন অতীতের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’ তিনি জানান, প্রশাসনসহ সর্বস্তরে দায়সারা কাজ হচ্ছে। লেভেল প্লেয়িং তৈরি করতে তফসিল ঘোষণার আগে এখন থেকেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচনী ব্যয় তদারকি, হলফনামার সঠিকতা যাচাইয়ে তৎপর থাকতে হবে ইসিকে। সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটিএন নিউজের শহিদুল আজম জানান, উৎসবমুখর পরিবেশ নিশ্চিতে ভোটারসহ জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। সবার জন্য সমান করতে আচরণবিধি প্রতিপালনে ইসির ভূমিকা দৃশ্যমান হতে হবে। ‘ফলাফলের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিবন্ধিত গণমাধ্যমকে অনেক ধরনের নিয়মনীতি মানতে হয়। অনিবন্ধিত গণমাধ্যম, ফেসবুক, ইউটিউব আটকানো যাবে না। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, বিলম্বিত তথ্য কাম্য নয়। জনসম্পৃক্ততা ও উৎসবমুখর নির্বাচন হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজকর্মও কমে যায়’ বলেন তিনি।

স্টার নিউজের হেড অব নিউজ ওয়ালিউর রহমান মিরাজ বলেন, ২০০৮ সালের পর নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ইসির আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। ইসির স্বাধীনতা কতটুকু ব্যবহার করতে পারছেন সেটা দেখার বিষয়। বর্তমান ইসির এখন পর্যন্ত আন-টেস্টেড। ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ভালো নির্বাচন করা। ইসির ওপর আস্থা কতটুকু আছে তা প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ ইসি এমন বড় নির্বাচন করার জন্য কতটুকু প্রস্তুত আমরা জানি না। বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা ফেরানোটা এখন ইসির দায়িত্ব। তিনি বলেন, প্রশাসন, পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। এখন ইসির দায়িত্ব মানুষের কনফিডেন্স ফিরিয়ে আনা। ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোর পরামর্শ একাত্তর টিভির সিইও শফিক আহমেদের।

ইসির নিজস্ব নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ‘ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার’ দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন তিনি। সিইসি ও ইসির মর্যাদা মন্ত্রীর ওপরে রাখা, মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধে উদ্যোগ চান এ সাংবাদিক। মিথ্যা তথ্য, অপতথ্য রোধে সহায়তার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান শফিক আহমেদ।

যমুনা টিভির তৌহিদুল ইসলাম জানান, ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার অবারিত করতে হবে। কমিশন সব কাজে স্বচ্ছ থাকতে চাই মুখে বললেও মাঠে তা দৃশ্যমান করতে হবে। ভোটে অনিয়মে বাধা দিলে নির্বাচন কর্মকর্তারা হেনস্তার শিকার হবে না এটা নিশ্চিত করতে হবে।

‘খেলোয়াড়রা ফাউল করবেই। খেলার সৌন্দর্য মোটা দাগের কথা। আয়োজকের অংশ হিসেবে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। কারা খেলছে যায় আসে না, আপনার রোবট হয়ে যান পক্ষপাতহীনভাবে; আপনারা ফেয়ার থাকবেন। ইসি যতই স্বচ্ছতার কথা বলুক, মাঠ কন্ট্রোল করা খুবই কঠিন। আমলাতন্ত্র আস্থাহীনতায় চলে গেছে, এ বাস্তবতায় চলতে হবে’ বলেন তিনি। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির মোস্তফা আকমল বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইসিকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

আস্থা সংকট কাটাতে সবাইকে নিয়ে তৎপর ইসি : মিথ্যা তথ্য ও অপতথ্য রোধে ইসির সেন্ট্রাল কো-অর্ডিনেশন সেল এবং বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সেল করার পরামর্শ দেন আলোচকরা। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, অপতথ্য নিয়ে সোশাল মিডিয়ার ব্যবহার ও এআই অপব্যবহার এখন বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবার এখন কমন কনসার্ন।

‘আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জটা বুঝতে পারছি। অপতথ্য রোধে মূলধারার গণমাধ্যমই বড় ধরনের সহায়তা করতে হবে।ৃবাস্তবতা হচ্ছে সঠিক তথ্যের অবাধ প্রবাহ। আমরা লিমিট করবো না; এতে ভালো ইনফরমেশনও বন্ধ হবে। সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে-এ ভাবনা মনে হয় না বাস্তব। কিছুটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে।’ অপতথ্য রোধে কোনোভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা নয়, বরং সঠিক তথ্যের অবাধ সরবরাহ বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।

নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল বলেন, ইসি কোনো লিমিট করবো না। আচরণবিধিতে সোশাল মিডিয়া কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আইসিটি অ্যাক্টসহ প্রচলিত আইন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা দরকার হবে। নভেম্বর থেকে সচেতনতা তৈরি ও কাউন্টার মেকানিজম তৈরি করতে পারি। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে কিছু কমিটি করা হবে। নির্বাচনী সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। নির্বাচন ভালো করতে হবে সবাইকে নিয়ে। আমরা সবাই ভাবমূর্তি সংকটে রয়েছি। এ আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠাই বড় চ্যালেঞ্জ। এখন কালেকটিভলি কাজ করলে সম্ভব বলেন আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট ভোটিং পদ্ধতি তুলে ধরেন এ নির্বাচন কমিশনার।

গণমাধ্যমের সহায়তা চান সিইসি : সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন টিভি সমাপনী ভাষণে গণমাধ্যমের সহায়তা চেয়ে বলেন, যা আপনারা পরামর্শ দেবেন, আমরা সত্যিকার পার্টনার হিসেবে পেতে চাই। ৃমিডিয়া ছাড়া আর কোনো গতি দেখি না। গণমাধ্যমের সহযোগিতা লাগবে, আপনাদের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে। বাধ্য হয়ে গণমাধ্যমকে পার্টনার করতে হবে, আপনাদের সহযোগিতা চাই।

আমরা সবাই ভাবমূর্তি সংকটে আছি- বললেন ইসি সানাউল্লাহ : নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল সানাউল্লাহ বলেছেন, আমি মনে করি আমাদের নির্বাচন যদি খারাপ হয়ে থাকে অতীতে সেটা কালেক্টিভ ডিসঅর্ডার। আমরা সবাই মিলে খারাপ করেছি। আর সামনে যদি আমাদের নির্বাচন ভালো করতে হয় সেটা কালেক্টিভলি আমাদেরকে ভালো করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। কারণ আমরা সবাই ভাবমূর্তি সংকটে আছি। সেটা নির্বাচন কমিশন বলি, পুলিশ বলি, প্রশাসন বলি, মিডিয়া বলি আমরা প্রত্যেকেই সবাই ভাবমূর্তি সংকটে আছি। ইসি সানাউল্লাহ বলেন, এই আস্থার সংকটটা কাটিয়ে ওঠাই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই নির্বাচন কমিশনের জন্য খুব ভালো হতো যদি আমরা মান ধরে রাখার কাজটা করতে পারতাম। আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে আমাদেরকে রিভার্স করতে হচ্ছে সবকিছু। এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে ডিসইনফরমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপপ্রয়োগ একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি পৃথিবীর অনেকগুলো ইলেক্টরাল ম্যানেজমেন্ট বডির সাথে মিটিং করেছি। নো লেস টু ডজন সবারই কমন কনসার্ন, অনেকে কনসার্ন এক্সপ্রেস করছেন যে, ইলেকশন টুডে ইজ বিং ফ্রি বাট নট ফেয়ার। বিকজ অব ইন্টারভেনশন অফ অ্যান্ড বিকজ অব মিসইউজ অফ সোশ্যাল মিডিয়া। আমি একটা উপাত্য তুলে ধরি। লাস্ট জার্মান ইলেকশনে ৮৮ ভাগ ভোটার ভেবেছেন ফেয়ার হবে না।

আবুল ফজল সানাউল্লাহ বলেন, এই যখন একটা গ্লোবাল বাস্তবতা আমি সাউথ আফ্রিকার ইলেকশন কমিশন মিটিং করছিলাম। তারা গত তিনটা নির্বাচন ধরে এটার ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। সক্ষমতা ডেভেলপ করেছে। করার পরে উনি বললেন, আমাদের পোস্ট ইলেকশন অ্যাসেসমেন্ট ছিল যে আমরা আমাদের চেয়ে আমাদের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণ করেছেন সাড়ে তিন গুণ বেশি প্রস্তুত ছিলেন। এটার ইন্টারভেনশন এ পর্যায়ে গিয়ে থেকেছিল যে, এক পর্যায়ে গিয়ে ইলেকশন তারা কন্ডাক্ট করতে পারেনি।

নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, এই যখন বৈশ্বিক বাস্তবতা, আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ অনেক। আমরা বুঝতেই পারছি। মিসইনফরমেশন ডিসইনফরমেশন যত বেশি ছড়াচ্ছে মানুষের মাঝেও কিন্তু সন্দেহ প্রবণতা তত বাড়ছে। যদিও বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে এটার প্রভাব এখনো অনেক বেশি আছে। আর প্রভাব আরেকটা কারণ হচ্ছে প্রিভিয়াস পজিশন ও কনফরমেশন বায়াস। যখন আমার পক্ষে যাচ্ছে তথ্যটা সত্য হোক মিথ্যা হোক আমি নিয়ে এটা সাথে সাথে পোস্ট করে দিচ্ছি। আর যখন আমার বিপক্ষে যাচ্ছি তখন আমি এটার বিরুদ্ধে একটা নোংরা কথা লিখছি। এটা কেমন যেন একটা বিহেভিয়ারাল ড্যামেজ হয়ে গেছে আমাদের সোশ্যাল মিডিয়াতে। তো আমরা যে ইনশাল্লাহ পদ্ধতিটা নিতে যাচ্ছি সংক্ষেপে সেটা বললাম। আমরা ওপেন এন্ডেড রাখব। আমরা কোন লিমিট করবো না। এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বিশেষ করে আমাদের নির্বাচনি সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। আমি যে তিনটা নির্বাচনের কথা বলছি তখন পর্যন্ত কিন্তু সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হয় নাই। বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এখন এটা একটা কালচারাল রূপ ধারণ করেছে কিন্তু সোসাইটিতে। মানে আমি ভেবে নিচ্ছি যে আমার সিলমারাটা আমি করলে এটা ঠিক আছে বা আমি যদি থাকতে পারি ঠিক আছে। এখানে অনেক কথাই রিফলেক্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত