
বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘অনেক ধরনের গুঞ্জন ও মিথ্যা সংবাদ’ করে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) একদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তাঁরা এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কোনো ধরনের ক্ষমতার জন্য, আসনের জন্য তাঁরা কারও সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা করবেন না। তাঁরা যদি একটি আসনও না পান, এনসিপি তার আদর্শ, নীতি ও লক্ষ্যে অটুট থাকবে।
গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর শাহবাগের শহীদ আবু সাঈদ কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম এসব কথা বলেন। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ৬ থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত দলীয় মনোনয়নপত্র বিক্রি শেষে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকে এনসিপির কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। সংবাদ সম্মেলনের পর একই সেন্টারে ৩০০ আসনের জন্য দলটির মনোনয়নপত্র নেওয়া ১ হাজার ৪৮৪ জন প্রার্থীর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করে এনসিপি। সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁদের দল নিয়ে অনেক ধরনের গুঞ্জন, অনেক ধরনের মিথ্যা সংবাদ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে এনসিপিকে একদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাঁরা পরিষ্কারভাবে বলেছেন, তাঁরা এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁরা তাঁদের নিজেদের রাজনীতি নিয়ে জনগণের কাছে যেতে চান। তবে তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহার, বিভিন্ন দাবি ও নীতি-আদর্শের সঙ্গে যদি কোনো দল বা শক্তি ঐকমত্য পোষণ করে, তাহলে তাদের সঙ্গে আলোচনা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা ওপেন (উন্মুক্ত) রয়েছেন। তাঁদের কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা যদি হয়, সেটা একটা নীতিগত ও আদর্শিক জায়গা থেকে হতে হবে। কোনো ধরনের ক্ষমতার জন্য, আসনের জন্য তাঁরা কারও সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা করবেন না। তাঁরা যদি একটি আসনও না পান, এনসিপি তার আদর্শ, নীতি ও লক্ষ্যে অটুট থাকবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা যদি কারও সঙ্গে কোনো ধরনের জোট বা আলোচনায় যাই, আমরা খুবই খোলামেলাভাবে সেটা নিয়ে কথা বলতে প্রস্তুত। দেশবাসীর কাছে আমরা বলব, এখানে কোনো গোপন কিছু নেই। কিন্তু একধরনের মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে—এর সঙ্গে আলোচনা বা ওর সঙ্গে আলোচনা। আমাদের মধ্যে যত মতবিরোধ থাকুক না কেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছে, বিভিন্ন প্রোগ্রামে যাচ্ছে, আলোচনা করছে। ইন্টারনাল (অভ্যন্তরীণ), ইনফরমাল (অনানুষ্ঠানিক) নানা আলোচনায় আমরা অংশগ্রহণ করছি। এটাই একটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। সে ধরনের আলোচনাকে একটাভাবে ফ্রেমিং করার চেষ্টা যাতে গণমাধ্যমের মাধ্যমে না করা হয়, সে জন্য গণমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ রইল।’
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দিকে ইঙ্গিত করে নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই সনদকে দর-কষাকষি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। একসময় তারা বন্ধু ছিল। তারা একটা চক্রান্ত করছে। একটা ভাগ-বাঁটোয়ারার সাজানো নির্বাচন, একটা সমঝোতার নির্বাচন করার পরিকল্পনা তারা করছে। এ ধরনের নির্বাচন হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের যে নতুন সম্ভাবনা, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটা ব্যর্থ হবে। এনসিপি এ ধরনের সমঝোতা বা বন্দোবস্তের নির্বাচনে কখনোই সায় দেবে না। বরং তারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।
‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই’ : আগামী নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ (সবার জন্য সমান সুযোগ) দেখছেন না মন্তব্য করে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানান এনসিপির আহ্বায়ক। তিনি বলেন, তাঁরা আগে থেকে এটা বলে আসছিলেন যে বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে জবরদখল, প্রশাসনের দখল, টাকার ব্যবহার, কালোটাকার ব্যবহার, পেশিশক্তির ব্যবহার ইত্যাদি সব সময় দেখে এসেছেন, শুনে এসেছেন। ফ্যাসিবাদী সময়ে তো মানুষ ভোট দিতেও যেতে পারেনি। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, সরকার ও প্রশাসনের যে শক্ত অবস্থানে থাকা প্রয়োজন, সেটা তাঁদের কাছে মনে হচ্ছে না। তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন, বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন, প্রশাসনকে কীভাবে দখল করতে হবে, প্রশাসনকে কীভাবে হাতে রাখতে হবে। সরকার ও ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের প্রশাসন যাতে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে জন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।
রোববার (গতকাল) ও সোমবার (আজ) এনসিপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। আবু সাঈদ কনভেনশন সেন্টারে সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলবে। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় করব। তাঁদের স্বপ্নের কথা শুনব। তাঁদের দক্ষতাণ্ডযোগ্যতার কথা শুনব। এনসিপির পক্ষ থেকেও আমরা আমাদের পরিকল্পনার কথা তাঁদের বলব। সর্বোপরি একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে এখান থেকে আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে চাই। এখানে (সাক্ষাৎকার) একটা প্রাথমিক যাচাই-বাছাই হবে। পরে আমাদের রাজনৈতিক পর্ষদ, যারা কেন্দ্রীয় সংসদীয় বোর্ড হিসেবে কাজ করবে, তারা চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে। এই যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই আমরা আমাদের তালিকাটি ঘোষণা করতে পারব বলে আশা করছি।’
‘মার্কা দেখে ভোট দেওয়ার সময় শেষ’ : সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানান, তাঁরা এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪৮৪টি মনোনয়নপত্র বিতরণ করেছেন। অর্থাৎ প্রতি আসনে তাঁদের গড়ে পাঁচজন করে প্রার্থী আছেন। অনলাইন ও অফলাইন দুটি প্রক্রিয়াতেই মনোনয়নপত্র বিতরণ করা হয়েছে। অফলাইনে ৭৬১ জন, অনলাইনে ৭২৩ জন মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। আজ থেকে তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। এর জন্য ১০টি বিভাগ অনুযায়ী ১০টি বোর্ড করা হয়েছে।
দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, আগে মানুষ যেভাবে দল ও মার্কা দেখে ভোট দিয়ে আসত, মাঠের সেই অবস্থা আর নেই। আগামী নির্বাচনে মানুষ বয়স, মার্কা ও পুরোনো দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে কাউকে বিজয়ী করে আনবে, সেই সময় শেষ হয়ে গেছে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা রাজনীতিতে নতুন ধারা যুক্ত করতে চাই। জবাবদিহির সংস্কৃতি যুক্ত করতে চাই।’ সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা মুজাহিদুল ইসলাম, আতিক মুজাহিদ, আবদুল্লাহ আল আমিন, মো. আতাউল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এনসিপি-এবি পার্টিসহ নতুন জোট কয়েক দিনের মধ্যেই- মঞ্জু : আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন জোট গঠন করা হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দল হিসেবে যারা সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছে, তাদের নিয়ে এই জোট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। জোটে এবি পার্টির সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল থাকবে।
গতকাল রোববার দুপুরে ফেনী শহরের একটি গণমিলনায়তনে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-২ আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে জনসংযোগ শুরু করেছেন মজিবুর রহমান। এরই অংশ হিসেবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় জোট গঠনের বিষয়ে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জাতীয়ভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জনগণের কাছে বিষয়টি তুলে ধরা হবে। জোট ঘোষণার সম্ভাব্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ নভেম্বর।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এবি পার্টি চেয়ারম্যান বলেন, ‘সুযোগ থাকার পরও বিএনপির সঙ্গে জোটে যাইনি। কারণ, বিএনপির অনেক নেতা এত বছর সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের দলের নমিনেশন পাওয়ার অধিকার আছে। তবে বিএনপি আমাদের জন্য কিছু সিট খালি রেখেছে- বিষয়টি সত্য নয়। বরং এসব প্রশ্নে আমরা বিব্রত হই। বিএনপি একটি পুরোনো দল, তারা তাদের মতো করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। আমরা নতুন দল হিসেবে আমাদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সংশয় দেখছেন না জানিয়ে মজিবুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে হবে। এ জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ফেনী-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে নিজের ঘাটলা বা বাড়িতে সালিস দরবার করবেন না, প্রশাসনকে কাজের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ এবং বাজার বা স্কুল কমিটির নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। বরং জেলা প্রশাসকসহ সব সরকারি দপ্তরে সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তা বাছাইয়ের চেষ্টা, সরকারি দপ্তরে কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সরকারি বরাদ্দের তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
এরই মধ্যে ফেনীর উন্নয়নে বিভিন্ন ভূমিকার কথা জানিয়ে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আগামী দিনে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেনীতে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সেনা ব্রিগেড স্থাপনের জন্য চেষ্টা করা হবে। সংস্কার প্রসঙ্গে মজিবুর রহমান বলেন, অভ্যুত্থানের পর সবাই মুক্তভাবে রাজনীতি করছে, এটা একটা বড় অর্জন। এখন যে কেউ সরকারপ্রধানের কড়া সমালোচনা করতে পারছেন, এটি কিছুদিন আগেও সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী পদে দুবারের বেশি কেউ থাকতে পারবেন না এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক করার মতো সংস্কার বাস্তবায়িত হলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অনেক পরিবর্তিত হবে। শেখ হাসিনার বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে মঞ্জু বলেন, শেখ হাসিনা দেশে এসে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন। প্রয়োজনে তিনি বা তার দল বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেতে আবেদন করতে পারেন। ফেনী জেলা এবি পার্টির আহ্বায়ক আহসানুল্লাহর সভাপতিত্বে সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহ আলম। এসময় উপস্থিত ছিলেন- দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহের হোসেন, যুগ্ম সদস্যসচিব নজরুল ইসলাম, মামুন আনসারী, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত সাজু, কোষাধ্যক্ষ শাহীন সুলতানী, প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক হাবীব মিয়াজী, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক জাহানারা মনি, সহদপ্তর সম্পাদক নাজরানা হাফিজ প্রমুখ।