
দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে নানা সমস্যায় জর্জরিত। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে অসন্তোষ ও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর ঘোষণায় সমস্যা যেন কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না দলটির।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলীয় কৌশল ও দলীয় নেতাদের মধ্যেই মতভেদ দেখা যাচ্ছে। ফলে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিভ্রান্তি বাড়ছে। বিএনপি নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২ আসন থেকে জোটের মনোনয়ন দেয়। কিন্তু ঋণ খেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে মাহমুদুর রহমান মান্নার রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। গতকাল বুধবার বিচারপতি মো. বজলুর রহমান ও বিচারপতি মো. মনজুর আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। অন্যদিকে, বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে এককভাবে ভোট করার ঘোষণা দিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম। আবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দ্রুত অভ্যন্তরীণ ঐক্য গড়ে তুলে স্পষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারণ না করতে পারলে বিএনপির জন্য সামনে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
রিট খারিজ, নাগরিক ঐক্যের মান্না নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না : ঋণ খেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। বুধবার বিচারপতি মো. বজলুর রহমান ও বিচারপতি মো. মনজুর আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে মান্নার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম ও ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিকুর রহমান। এ প্রসঙ্গে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ চেয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না রিট করেছিলেন। আদালত রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন। এর ফলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। মান্নার আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, হাইকোর্টের রিট খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব। এর আগে ১০ ডিসেম্বর নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান আফাকু কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের কাছে খেলাপি ৩৮ কোটি ৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা আদায়ে ‘কল ব্যাক নোটিশ’ জারি করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের বগুড়া বড়গোলা শাখা। মান্না ও তার দুই অংশীদারের ঠিকানায় পাঠানো এই নোটিশে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়। শাখা প্রধান তৌহিদ রেজার স্বাক্ষরিত নোটিশটি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম নাজমুল কাদির শাজাহান চৌধুরীর ঠিকানায় পাঠানো হয়।
তথ্য অনুযায়ী, আফাকু কোল্ড স্টোরেজে মান্না ৫০ শতাংশ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম নাজমুল কাদির শাজাহান চৌধুরী ২৫ শতাংশ এবং তার স্ত্রী ও পরিচালক ইসমত আরা লাইজু ২৫ শতাংশ অংশীদার। গত ৩ ডিসেম্বর পাঠানো নোটিশে বগুড়ার শিবগঞ্জের কিচক বাজারে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির কাছে খেলাপি বিনিয়োগ বাবদ মোট ৩৮ কোটি ৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্যাংকের নোটিশে বলা হয়, ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে ২২ কোটি টাকা বিনিয়োগ অনুমোদন দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত মুনাফা, চার্জ ও জরিমানা পরিশোধ করেনি। ফলে বকেয়া বেড়ে বর্তমান পরিমাণে দাঁড়িয়েছে। লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও কোনোরকম অগ্রগতি না থাকায় চূড়ান্ত সতর্কতা হিসেবে এই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। ২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ বকেয়া পরিশোধ না করলে ব্যাংক আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়। ইসলামী ব্যাংক বগুড়া বড়গোলা শাখার প্রধান তৌহিদ রেজা বলেন, মাহমুদুর রহমান মান্না ঋণখেলাপি হওয়ার পরও টাকা পরিশোধে কোনো উদ্যোগ নেননি। প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক হলেও তিনি চুক্তি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করেননি। তাই নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে এককভাবে ভোট করার ঘোষণা অলির : বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে এককভাবে ভোট করার ঘোষণা দিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম। বুধবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এই ঘোষণা দেন। দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর মগবাজারের গুলফেশা টাওয়ারে এলডিপির পার্টি অফিসে এই সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন অলি আহমদ বীরবিক্রম।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র তুললেন রুমিন ফারহানা : আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। বুধবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে রুমিন ফারহানার পক্ষে সরাইল উপজেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আলী হোসেন মনোনয়ন ফরমটি সংগ্রহ করেন। এর মধ্য দিয়ে দলীয় মনোনয়ন না পেয়েও তিনি নির্বাচনে লড়ার নিজের পূর্ব ঘোষণা বাস্তবায়নে প্রথম ধাপ সম্পন্ন করলেন রুমিন ফারহানা। গত কয়েকদিন ধরে রুমিন ফারহানা দৃঢ়ভাবে জানিয়ে আসছিলেন যে, বিএনপি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের জন্য দলীয় মনোনয়ন না পেলেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। গত সপ্তাহে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘মার্কা যা-ই হোক, সরাইল-আশুগঞ্জ থেকেই নির্বাচন করব।’
রুমিন ফারহানা এর আগে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সাথে আলোচনায় বলেছিলেন, বিএনপি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে জোট করার কারণে তাদেরকে আসন দিতে হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে তিনি মনোনয়ন পাননি। তবে তিনি দলীয় শৃঙ্খলার প্রতি সম্মান রেখেই আগাম পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। রুমিন ফারহানার বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার পর রুমিন ফারহানা এখন জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি ইতোমধ্যে তার নির্বাচনী অফিস স্থাপন এবং প্রচারকার্য ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের মনোনয়ন পেয়েছেন বাংলাদেশ জমিয়তে উলামার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব। গত মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) দুপুরে দলের মহাসচিব মির্জা ফাখরুল ইসলাম আলমগীর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবের মনোনয়নের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- ২ আসনটি বর্তমানে সরাইল, আশুগঞ্জ ও বিজয়নগর উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত। এখানে মোট ভোটার আছেন ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে সরাইল উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ভোটার আছেন ২ লাখ ৮৮ হাজার ৬০৯, আশুগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউনিয়নে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৯৯ ও বিজয়নগর উপজেলার দুটি ইউনিয়নে ভোটার আছেন ৫৭ হাজার ৭৪০ জন।