প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৪ আগস্ট, ২০২৫
ইসলাম মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা দিয়েছে। তাই চুরি, ডাকাতি ইত্যাদিকে বড় অপরাধ বলে সাব্যস্ত করেছে। এসবের জন্য অঙ্গ কর্তনসহ গুরুতর শাস্তির বিধান রেখেছে। আল্লাহ বলেন, ‘যে পুরুষ ও যে নারী চুরি করে, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও, যাতে তারা নিজেদের কৃতকর্মের প্রতিফল পায় (এবং) আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। আল্লাহ ক্ষমতাবান, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা মায়িদা : ৩৮)। কেউ যেন অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ আত্মসাৎ করতে না পারে, সেজন্য ইসলামে রয়েছে কঠোর নির্দেশনা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ ভোগ করো না এবং জনগণের সম্পদের সামান্য অংশও জেনে-শুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশে শাসন-কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিও না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)।
সম্পদ বিনষ্টে বিভেদহীন বিধান : ইসলামে চুরির শাস্তি প্রদানে ধনী ও গরিবের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আয়েশা (রা.) একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, মাখজুম গোত্রের একজন নারীর চুরির ঘটনা কোরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল, এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে কে আলাপ করতে পারে? তারা বলল, একমাত্র রাসুল (সা.)-এর প্রিয় পুত্র উসামা বিন জায়েদ (রা.) এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন। উসামা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কথা বললেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘনকারিণীর শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছ?’ এরপর নবীজি (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবায় বললেন, ‘তোমাদের আগের জাতিসমূহকে এ কাজই ধ্বংস করেছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা শাস্তিতে তাকে ছেড়ে দিত।
অন্যদিকে যখন কোনো অসহায়-গরিব সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করত, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।’ (বোখারি : ৩৪৭৫)।
সম্পদ ক্ষতির সম্ভাবনাও নিষিদ্ধ : যেসব লেনদেনের মাধ্যমে কারও সম্পদ ক্ষতি হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকে, যেমন- সুদ, ঘুষ, জুয়া, লটারি, অবৈধ ব্যবসা ইত্যাদি, সেগুলো ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সুদগ্রহণ করা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যেসব বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। এরপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারো প্রতি অত্যাচার কর না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯)। যেসব ব্যবসায়ী মাপে কম দেয়, তাদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য রয়েছে মহাদুর্ভোগ।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১)।
সম্পদ সুরক্ষায় লিখে রাখা : ঋণগ্রহণ করে কেউ যেন ঋণদাতাকে প্রতারিত করতে না পারে, সেজন্য নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণের লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখে রাখা ও সাক্ষী রাখার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা যখন নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণের লেনদেন কর, তখন তা লিখে রাখ এবং তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে দুজন সাক্ষী রাখ। যদি দুজন পুরুষ সাক্ষী না পাওয়া যায়, তাহলে একজন পুরুষ ও দুজন নারীকে সাক্ষী রাখ।’ (সুরা বাকারা : ২৮২)। ইসলামের এ নির্দেশনা অনুসরণের মাধ্যমে মানুষের অর্থ-সম্পদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাই এসব বিধিবিধান মেনে চলার মধ্যেই সবার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের তিনটি কাজ অপছন্দ করেন- ১. অনর্থক কথাবার্তা, ২. সম্পদ নষ্ট করা এবং ৩. অত্যধিক প্রশ্ন করা।’
(বোখারি : ১৪৭৭)। হাদিসে বর্ণিত ‘সম্পদ নষ্ট করা’ কথাটি অনেক ব্যাপক। চতুর্থ শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ আল্লামা খাত্তাবি এ প্রসঙ্গে অতি উত্তম ও সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, সম্পদ নষ্ট করার অনেক পন্থা রয়েছে। তবে এর মূল কথাটি হলো, ব্যয় করার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করা, অপাত্রে ব্যয় করা, প্রয়োজনীয় খাতে খরচ না করে অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করা। তিনি আরও লিখেছেন, একজন ব্যক্তির এমন কিছু সম্পদ রয়েছে, যেগুলোর যথাযথ যত্ন না নিলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন- গোলাম, বাদী, গবাদি পশু ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে এসবের যথাযথ ও প্রয়োজনীয় যত্ন না নেওয়াও হাদিসে বর্ণিত সম্পদ নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত হবে। (আল্লামা খাত্তাবি কৃত শরহে বোখারি)।
খেলাধুলার ছলে সম্পদ বিনষ্ট না করা : বর্তমানে আমরা একটি প্রবণতা লক্ষ করে থাকি। অনেক বাবা-মা বা পরিবারের কোনো সদস্য কখনও বাচ্চাদের হাতে মূল্যবান জিনিসপত্র দিয়ে দেন, কখনও তারা নিজেরাই ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে খেলাধুলা শুরু করে। বড়রা দেখেও তাদের হাত থেকে সেটা গ্রহণ করেন না। অথচ জিনিসটি তাদের হাতে নষ্ট হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা খাত্তাবি লিখেছেন, ‘বুঝমান নয় এমন কারও কাছে সম্পদ দেওয়াও সম্পদ নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত। এখান থেকে প্রমাণিত হয়, নিজের সম্পদ নষ্ট করে ফেলে (যেমন- শিশু ও পাগল) এদের ওপর লেনদেনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা বৈধ রয়েছে।’ তাছাড়া সুরা নিসার আয়াত ‘অবুঝদের হাতে তোমরা নিজেদের সেই সম্পদ অর্পণ করো না, যাকে আল্লাহ তোমাদের জীবনের অবলম্বন বানিয়েছেন’ (আয়াত : ৫) এখান থেকেও এ ধরনের আচরণের অসঙ্গতি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। শিশুদের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ আচরণ ইসলামের একটি বিশেষ শিক্ষা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শরিয়তের স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত বিধান লঙ্ঘন করা কাম্য নয়।