ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উপার্জনের ইসলামি রূপরেখা

ফয়জুল্লাহ রিয়াদ
উপার্জনের ইসলামি রূপরেখা

জীবিকা মানুষের মৌলিক অধিকার। মানুষকে হালাল পন্থায় প্রয়োজন অনুপাতে জীবিকা উপার্জন করতে আদেশ করেছে ইসলাম। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যখন জুমার নামাজ শেষ হয়ে যাবে, তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অন্বেষণ করবে। আর আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে; যেন তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সুরা জুমা : ১০)। নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন অনুপাতে সম্পদ উপার্জন ও সঞ্চয় করা ইসলামি শরিয়তে অপছন্দনীয় কিংবা মাকরুহ নয়; তাসাউফ, তাকওয়া কিংবা তাওয়াক্কুল পরিপন্থিও নয়। বরং হালাল উপায়ে প্রয়োজন পরিমাণ জীবিকা উপার্জন করা বৈধ ও অনুমোদিত।

উপার্জন হবে হালাল পন্থায় : জীবিকা উপার্জনের জন্য শরিয়ত নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম কিংবা হারামপন্থা অবলম্বন করা যাবে না। হারাম সম্পদ ভক্ষণকারী ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম অবধারিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা এতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে। অচিরেই তারা জ্বলন্ত আগুনে (জাহান্নামে) প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা : ১০)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও উৎকৃষ্ট বস্তু আছে, তা থেকে তোমরা খাও। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : ১৬৮)। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হারাম সম্পদ দ্বারা লালিত-পালিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহুত তারগিব : ১৭৩০)।

নবীজির দুনিয়াবিমুখতা : ধন-সম্পদ উপার্জন করতে হবে কেবল পার্থিব জীবনের প্রয়োজনে। এ সহায়-সম্পত্তির প্রতি লালায়িত বা আকর্ষিত হওয়া যাবে না। পার্থিব জগতটাকেই নিজের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু বানানো যাবে না। বরং প্রয়োজনের বাইরে পুরোপুরি দুনিয়াবিমুখ থাকতে হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার কাছে যদি ওহুদ পাহাড় সমান স্বর্ণ থাকত, তাহলেও এটা আমার পছন্দ নয় যে, তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও তার কিছু অংশ আমার কাছে থাকুক। তবে এতটুকু পরিমাণ ছাড়া, যা আমি ঋণ পরিশোধ করার জন্য রেখে দিই।’ (বোখারি : ২২৩১)।

পার্থিব ভোগবিলাস মোমিনের জন্য নয় : ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে গেলাম। তিনি তখন খেজুর পাতার চাটাইয়ের ওপর শোয়া ছিলেন। আমি বসে পড়লাম। তার পরিধানে ছিল একটি লুঙ্গি। এছাড়া আর কোনো কাপড় ছিল না। তার পাঁজরে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিল। আমি দেখলাম, তার ঘরের এক কোণে প্রায় এক স গম, বাবলা গাছের কিছু পাতা এবং ঝুলন্ত একটি পানির মশক। এ অবস্থা দেখে আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হলো। নবীজি (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কাঁদছ কেন?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর নবী! আমি কেন কাঁদব না! এই চাটাই আপনার পাঁজরে দাগ কেটে দিয়েছে, আর এই হচ্ছে আপনার ধনভাণ্ডার, এতে যা আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এই কিসরা (পারস্যরাজ) ও কায়সার (রোম স¤্রাট) বিরাট বিরাট উদ্যান ও ঝরনাসমৃদ্ধ অট্টালিকায় বিলাসবসনে জীবনযাপন করছে। আর আপনি হলেন আল্লাহর নবী এবং তার মনোনীত প্রিয় বান্দা। আর আপনার ধনভাণ্ডারের অবস্থা এই।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমাদের জন্য রয়েছে আখেরাতের স্থায়ী সুখ-শান্তি এবং ওদের জন্য রয়েছে পার্থিব ভোগবিলাস?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১৫৩)।

মোমিন পৃথিবীতে প্রবাসী বা পথচারী : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার শরীর স্পর্শ করে বললেন, ‘পৃথিবীতে এমনভাবে দিনযাপন কর, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী মুসাফির। তুমি নিজেকে কবরবাসীদের অন্তর্ভুক্ত মনে কর।’ (তিরমিজি : ২৩৩৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, দুনিয়াবিমুখ মনমেজাজ যেন বজায় থাকে, এজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) সবসময় এ দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াকে আমার সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়, আমার জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু এবং আমার চূড়ান্ত কামনা-বাসনার বস্তু বানিয়ো না।’ (জামে সগির : ২১৪৮)।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ, রাজাবাড়ি, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত