প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৯ নভেম্বর, ২০২৫
বিশ্ব অর্থব্যবস্থা এক চরম সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশে দেশে জনরোষের বিস্ফোরণ ঘটছে। পরিবারগুলোতে দিন দিন হাহাকার বাড়ছে। একদিকে মুদ্রাস্ফীতির খড়গ নামছে, অন্যদিকে খাদ্য সংকট ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অপর্যাপ্ততা অসংখ্য পরিবারের অর্থনৈতিক চাকা থামিয়ে দিচ্ছে। এ সংকট থেকে সহসা উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ছে অর্থনৈতিক এ ধকল। এমতবস্থায় পরিবারের অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবা সময়ের প্রয়োজন। পরিবারের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ও প্রভাবমুক্ত সুস্থ মানসিকতা দরকার। যে সমাজে আমরা বসবাস করছি, তাতে ব্যয় অনুপাতে আয় উপার্জন করাকেই নীতি মনে করা হয়। অন্যদিকে পরিবারের ব্যয় ও খরচ করার জন্য এমন এমন উপলক্ষকে অপরিহার্য মনে করা হয়, যা অপ্রয়োজনীয় এবং লাগামহীন। পারিপার্শ্বিকতা এবং অহংবোধ যেখানে ব্যয়ের নীতি নির্ধারণ করে। এটা সুস্থ মানসিকতা নয়। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ দুর্নীতি করতে বাধ্য হয়। এভাবে একটি সমাজ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বর্তমান অর্থব্যবস্থা এর বাস্তব উদাহরণ। পারিবারে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে, আমাদেরকে বাস্তবতা গুরুত্ব দিতে হবে। অযাচিত ব্যয়ের কারণগুলো নির্ণয় করে তার সঠিক প্রতিকার করতে হবে। সঠিক চাহিদা ও বাস্তব প্রয়োজন কী কী? অর্থনৈতিক সংকটগুলো কোন কোন দিক থেকে প্রভাবিত করছে, তা নির্ণয় করে এর সঠিক প্রতিকার করা জরুরি।
পারিবারিক সংকটের প্রধান কারণ : অর্থব্যবস্থার ওপর ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)। গ্রন্থটির নাম ‘কিতাবুল কাসব’। এ গ্রন্থে তিনি ব্যয় ও খরচের ক্ষেত্রে হারাম বা নিষিদ্ধ মৌলিক কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে পারিবারিক ভারসাম্যহীনতা ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ এগুলোই। তিনি বলেন, ‘হালাল উপার্জনের পরও মানুষের ওপর ব্যয় সংক্রান্ত মৌলিক পাঁচটি কাজ নিষিদ্ধ। যথা- ফ্যাসাদ করা, অপচয় করা, অহমিকাবোধ থাকা, প্রদর্শনপ্রিয়তা, সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা।’ (কিতাবুল কাসব : ১৬৭)।
১. ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা : ফ্যাসাদ একটি ব্যাপক বিষয়। যে কোনো ক্ষেত্রেই তা ঘটতে পারে। তবে এখানে খাদ্য ও জীবিকা সম্পর্কিত ফ্যাসাদ উদ্দেশ্য। কৃত্রিম খাদ্য সংকটসহ মানুষের অসততা যে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে, ওই বিষয়গুলো নিষিদ্ধ ও অন্যায়।
এ জন্য সিন্ডিকেট করা, ধোঁকা দেওয়া, মিথ্যা বিবরণ দিয়ে পণ্য চালিয়ে দেওয়া, মাপে কম দেওয়া, সুদণ্ডঘুষ লেনদেন করা, দোষ গোপন করে বিক্রি করাসহ বিভিন্ন বিষয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব কারণে সামগ্রিকভাবে সমাজ প্রভাবিত হয় এবং মানবজীবন বিপন্ন হয়। বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে এই ফ্যাসাদ অন্যতম দায়ী।
২. অপচয় করা : অপচয়ের বিভিন্ন রূপ আছে। খাদ্য অপচয়ের ক্ষেত্রেও নানান দিক আছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পেটের চেয়ে খারাপ কোনো পাত্র আদম সন্তান পরিপূর্ণ করে না। একান্ত পেট ভরে যদি খেতেই হয়, তাহলে পেটের তিন ভাগের এক ভাগ পরিমাণ খাবার ও এক ভাগ পরিমাণ পানি পান করবে। আরেক ভাগ খালি রাখবে।’ (তিরমিজি : ৪/৫৯)। এ হাদিস থেকে বোঝা গেল, খাদ্য নষ্ট করলেই শুধু অপচয় হয় না; বরং খাবার গ্রহণ করার মধ্যেও অপচয় রয়েছে।
৩. অর্থনৈতিক অহমিকা : আধুনিক অর্থনীতি যে মানসিকতাগুলোর ওপর তার ভিত্তি রচনা করেছে, তার অন্যতম হলো- এ অহমিকা ও অহংকারবোধ। সম্পদে অন্যের ওপর নিজের প্রাধান্য সৃষ্টির মনোভাব ও অর্থ-সম্পদের ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা নির্ণয় করার ব্যাধিতে আজ গোটা সমাজ আক্রান্ত। পেশাগত শ্রেণি-বৈষম্য তার নমুনা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অহংকার ও অপব্যয় না করে তোমরা ইচ্ছেমতো পানাহার করো, পরিধান করো এবং দান করো।’ (বোখারি : ৭/১৪০)।
৪. সম্পদে প্রদর্শনী মনোভাব : নতুন নতুন আধুনিক ডিজাইনের জামা-কাপড় থেকে হাতের ঘড়ি, মোবাইলসহ যাবতীয় ক্ষেত্রে এ প্রবণতা মহামারির রূপ নিচ্ছে। পুজিবাদিরা ভোক্তাদের মাঝে এমন হীন মনোভাব ও মানসিকতা সৃষ্টি করে কষ্টার্জিত পয়সাগুলো লুটে নিচ্ছে। যার ফলে এক শ্রেণির পরশ্রীকাতর ও প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের মধ্যে নগ্নভাবে ফ্যাশনপ্রিয়তা বাড়ছে। আত্মপ্রকাশপ্রিয়তা এবং প্রদর্শনীর মনোভাব এতটাই মারাত্মক রূপ নিচ্ছে যে, অন্তহীন এক চাহিদার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে স্বল্প আয়ের সাধারণ পরিবারগুলো। এ কারণে আল্লাহতায়ালা তা হারাম করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সেদিন কেমন হবে, যখন তোমরা সকাল-বিকাল জামা পরিবর্তন করবে, বাহারি রকমের খাবার থাকবে; এক প্লেট দেওয়া হবে, আগেরটা তুলে নেওয়া হবে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘আমরা তো তখন আজকের চেয়ে ভালো থাকব। কারণ, উপার্জনের ঝামেলা থাকবে না। ফলে আমরা নির্বিঘ্নে ইবাদত করতে পারব।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘বরং সেদিনের চেয়ে আজকেই তোমরা ভালো আছ।’ (তিরমিজি : ২৪৭৬)।
মাসের শুরু-শেষে ভারসাম্য বজায় : যারা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, তাদের ক্ষেত্রে এটি একটি উত্তম সমাধান। এ বিষয়ে উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.)-এর পিতার পরিবারকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। মুফতি শফি (রহ.) তার পিতা মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াসিন (রহ.) সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার পিতা যখন দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেন, তখন আমাদের পরিবারে অনেক অভাব ছিল। অন্যদিকে তার বেতন ছিল একেবারে সামান্য। এরপরও আমাদের পরিবারে কখনও ঋণ করার প্রয়োজন হয়নি কিংবা খানাখাদ্যের পেরেশানি হয়নি। তিনি মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই নিয়মে খরচ করতেন। মাসিক এ সামান্য আয় থেকে আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া কিংবা মেহমানদারি করার জন্যও সাধ্যমতো অংশ রাখতেন। আপদকালীন বিভিন্ন প্রয়োজনের জন্যও কিছু অংশ থাকত।’ (মেরে ওয়ালিদ মাজিদ : ৭৮)।
প্রভাবিত না হওয়া : সমাজবদ্ধতা মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য। এ কারণে মানুষকে সামাজিক জীব বলা হয়। কিন্তু এই সভ্যযুগে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাঝে এমন অসভ্য কিছু সামাজিকতা সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বস্তি ও শান্তির জন্য প্রতিবন্ধক। ইবনে খালদুন (রহ.) বলেন, ‘শহরের বাসিন্দাসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নগরজীবনের ব্যয়-বিলাসিতাও বাড়তে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক শ্রেণির মানুষ সমশ্রেণির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। বিচারকশ্রেণি অনুরূপ বিচারকদের মতো চলে; ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায়ীদের মতো সমতাল রক্ষা করে জীবনমান নির্ধারণ করে।’ (মাজাল্লাতুল ইকতিসাদ, মহররম সংখ্যা ১৪৪৪)। ইবনে খালদুন (রহ.) যে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তা হলো- মানুষ সমজাতীয় মানুষকে অনুসরণ করে। নিজের ব্যয় ও জীবনমান নির্ধারণে সমশ্রেণি ও একই রকম সম্প্রদায়ের মানুষদের লক্ষ্য করে। একই রকম পেশায় থেকে একজন বেশি খরচ করতে থাকলে অন্যদের মধ্যে তাল মেলানোর প্রবণতা তৈরি হয়। সেখান থেকে তৈরি হয় পারিবারিক অশান্তি, তারপর শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা। এটি এক বড় সংকট। এ ধরনের কোনো সংকট আমাদের পরিবারে প্রভাব ফেলছে কি-না, তা নির্ণয় করা ও প্রতিকারের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই।
ব্যয় সীমিত করা : উপার্জনের জন্য মানুষ চেষ্টার সবটুকু করতে পারে, কিন্তু সে অনুযায়ী ফলাফল লাভ করা নিজের হাতে নেই। আমাদের জন্য সম্ভব হলো, ব্যয় কমিয়ে আনা। যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে আগে প্রয়োজন পূর্ণ করা হতো, সে পরিমাণ অর্থের মধ্যেই চলার চেষ্টা করা চাই।
নতুন উপায় বের করা : আল্লাহতায়ালা আমাদের যে সামর্থ্য দান করেছেন, তার অপচয় না করা। হালালভাবে নতুন নতুন উপায় অনুসন্ধান করে জীবিকা নির্বাহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হওয়া চাই। হাদিসে এসেছে, ‘শক্তিশালী মোমিন ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তির চেয়ে উত্তম। অবশ্য উভয়ের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে।
তোমরা উপকারী কাজে নিমগ্ন হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। আর অপারগ হয়ে বসে থেকো না।’ (মুসলিম : ২৬৬৪)। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনশীল উপার্জন মাধ্যমকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এতে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও সহযোগিতা হয়। সামগ্রিক অর্থনীতিতে অবদান রাখা হয়। তাছাড়া উৎপাদনশীল খাতগুলো সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। হাদিসে এসেছে, ‘মুসলমান যখন গাছ লাগায় অথবা ফসল ফলায়, তখন সে গাছ বা ফসল থেকে কোনো মানুষ কিংবা পশু বা পাখি কিছু খেলে তার বিনিময়ে সে কেয়ামত পর্যন্ত সদকার সওয়াব লাভ করতে থাকবে।’ (মুসলিম : ১৫৫২, ২৫৫২)।