প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫
‘কর্পোরেট’ শব্দ শোনামাত্র স্মার্টনেসের ভাবসাব উপলব্ধি হয়। ঠিক তেমনি কর্পোরেট চাকরিও। কর্পোরেট শব্দটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি সম্পর্কিত একটি শব্দ; যা ব্যবসায়িক সেবা বা উৎপাদনে নিজস্ব একটি শ্রেণিকে বোঝায়। এটি প্রধানত বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে ব্যবসার বিষয়বস্তু এবং পরিচালনা সম্পর্কিত নীতিমালা এবং পদক্ষেপগুলো কার্যকরী হয়। সহজে বলতে গেলে, কর্পোরেট চাকরি মানে কোনো বড় কোম্পানির অধীনে চাকরি করা। বর্তমান দুনিয়ায় কর্পোরেট জবের চাহিদা ব্যাপক। দক্ষতা বৃদ্ধি করে যারা এ সেক্টরে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেন, তারাই সফল।
কর্পোরেট চাকরির চাহিদা : আগে প্রায় কিংবা বর্তমানে শোনা যায়, শুধু সরকারি চাকরি মানে সোনার হরিণ। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। চাকরির বাজারে রাজ করছে কর্পোরেট সেক্টর। বর্তমানে কর্পোরেট জবও সোনার হরিণে রূপ নিয়েছে। এসব সেক্টরের উচ্চমানের স্যালারি, উচ্চমানের সুযোগ-সুবিধার জন্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেট সেক্টরে বেড়ে চলছে চাকরি পাওয়ার প্রতিযোগিতা। নির্দিষ্ট যোগ্যতা নিয়ে এবং সঠিক মাপপথে যদি যোগ্যস্থানে চাকরি করা যায়, তাহলে মাস শেষে স্যালারি হয়ে যায় পাঁচ-ছয় সংখ্যার কিংবা তারও বেশি। এর সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো থাকছেই।
করপোরেট চাকরির যোগ্যতা : কর্পোরেট চাকরিতে প্রতিদিনই টিকে থাকার লড়াইয়ে শামিল হতে হয়। এর জন্য যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, তা জানা থাকা দরকার। যেমন-
কাজের বিষয়ে স্পষ্টতা : আপনার প্রতিটি কাজে স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আপনি কী করতে চান এবং চাকরির নিয়মে কী রয়েছে, সেসব বিষয়ে স্পষ্ট থাকুন। কোন কাজটি বেশি পছন্দ এবং কোনটিতে দক্ষ, তা জানান। সে অনুযায়ী পছন্দের কাজটি পেয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যারা অভিজ্ঞ, তাদের পরামর্শও নিন।
হাতে-কলমে শেখা : গবেষণায় প্রমাণিত, একজন মানুষ শুনে যতটা শিখতে পারে, তার থেকে দেখে দেখেই শিখে ফেলার সম্ভাবনা প্রায় ৭০ ভাগ বেশি। যদি কাউকে কিছু শেখাতে চান, তবে মোবাইল-ফোন, মেসেঞ্জার কল বা অন্য কোনোভাবে শুনিয়ে শুনিয়ে শেখানোর চেয়ে হাতে-কলমে শেখানোটা অনেক বেশিই কার্যকর। আপনি যাকে শেখাতে চান, সে যদি ঠিকমতো না-ই শিখতে পারে, তবে আপনার উদ্দেশ্য সফল হলো না। আবার তার পেছনে ব্যয় করা সময়টাও মাঠে মারা গেল।
আর যদি সে শিখেও ফেলে, তবু শুনে শুনে কেউ মনে রাখতে পারে ২০ ভাগ। আর দেখে মনে রাখতে পারে তার দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪০ ভাগ। এ তথ্যই প্রমাণ করে, হাতে-কলমে শিখিয়ে দেওয়ার গুরুত্ব কতটুকু।
শক্ত নেটওয়ার্কিং : মানুষের সঙ্গে কথা বলা এবং যোগাযোগ রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হয়তো আপনি জানেন না। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বন্ধু তৈরি করা একটি উপকারী বৈশিষ্ট্য। এর মাধ্যমে আপনি ভালো চাকরি এবং পছন্দের পজিশন পেতে পারেন, যেমনটা আগে হয়তো কখনও চিন্তাও করেননি।
মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করা : প্রথমেই মানুষের স্বরূপ অর্থাৎ তার প্রকৃতি সঠিকভাবে বুঝতে পারা দরকার। যখন আপনি ভালোভাবে মানুষকে বুঝতে পারেন অথবা জানতে পারেন মানুষের একেকটা আচরণের পেছনে কী ধরনের কারণ থাকতে পারে, তখন আপনি বুঝে যাবেন বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ বা কোন কথার সময় কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া মানুষের থেকে পাওয়া যায়। যেমন ধরুন- আপনি ও আপনার বন্ধু মিলে ছোটখাটো একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। ধরা যাক তার রাগ একটু বেশি। কিন্তু এসব ছোটখাটো বিষয়ে রাগারাগি ব্যবসার উন্নতিতে ক্ষতি করতে পারে। আপনি যদি বুঝে নিতে পারেন, আপনার বন্ধু আসলে কী ধরনের কথা বললে রাগের প্রতিক্রিয়া দেখান, তবে আপনারই লাভ। আপনি সহজেই সেগুলো এড়িয়ে গিয়ে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারবেন।
সকল পরামর্শ গ্রহণ : প্রত্যেকের পরামর্শই মন দিয়ে শুনবেন, সেগুলো যতই অযৌক্তিক হোক না কেন। মেনে চলুন কিংবা না চলুন, কান সব সময় খোলা রাখবেন। কার কোন পরামর্শ কখন কাজে লেগে যাবে, হয়তো আপনি বুঝতেও পারবেন না। সবার পরামর্শ নিলেও সেই কাজ করবেন, যেটি আপনি করতে চান বা যেটি করতে আপনার মন সায় দিচ্ছে।
দক্ষতার দৌড়ে পেশার টেকসই : পড়াশোনা শেষ করে বর্তমান তরুণ কিংবা চাকরিপ্রত্যাশী ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কে সরকারি চাকরির চিন্তা ভর করে। এর জন্য রাতদিন পড়াশোনায় ডুবে থাকে। কিন্তু এসব ছেলেমেয়ে সরকারি চাকরি না পেয়ে সবশেষে যুক্ত হতে চায় কর্পোরেট সেক্টর কিংবা কোম্পানিগুলোতে। কিন্তু তারা অদক্ষতা, মানসম্মত সিভি না থাকা, পাবলিক স্পিকিং, গ্রুপিং, কম্পিউটার স্কিল, এক্সেল, মার্কেটিং অদক্ষতা, পাওয়ার পয়েন্টসহ নানান সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য এখানে এসেও ব্যর্থ হয়। অথচ এসব সেক্টরে চাকরি পেতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় চাকরিপ্রাপ্তির সিভি এবং পরবর্তীতে অন্যসব দক্ষতা। মনে করুন, আপনার যে কোম্পানিতে চাকরি হলো, সেটা একটা ভলেন্টিয়ার অর্গানাইজেশন। তারা মূলত সেবাবিষয়ক কর্মশালা করে থাকে। এখন আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, প্রতিদিন দশজন করে মানুষ নির্বাচন করা এবং তাদেরকে বাংলাদেশ সম্পর্কে বোঝানো। এখন আপনি দশজন মানুষ নির্বাচন করেছেন ঠিকই, কিন্তু একটি রুমে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছেন না। আপনার হাঁটু কাঁপছে, কথায় জড়তা চলে আসছে। তাহলে আপনি পরিপূর্ণ নন। তাই ‘পাবলিক স্পিকিং’ও মানসম্মত সিভির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া উল্লেখযোগ্য রয়েছে গ্রুপিং, কম্পিউটার স্কিল, এক্সেল, মার্কেটিং দক্ষতা, পাওয়ার পয়েন্ট, ভাষাগত মাধুর্যসহ নানান সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কর্পোরেট চাকরি পাওয়ার উপায় : কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি পাওয়ার জন্য বেশ কিছু মাধ্যম রয়েছে। যেমন-
লিঙ্কডইন : বর্তমানে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুযোগ হলো ‘লিঙ্কডইন’। এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতোই একটি প্লাটফর্ম। এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন পদে নিয়োগ সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে থাকে। আপনি যদি নিজেকে নিয়োগ দেওয়া পোস্টে যোগ্য মনে করেন, তাহলে আপনার সিভি পাঠান। এছাড়া পাবেন কর্পোরেট জগতের প্রায় সবাইকে। হতে পারে সেটা কোম্পানির এমডি কিংবা পরিচালক। তাই আপনার একটি সচল ‘লিঙ্কডইন’ (LinkedIn) থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
জব ফেয়ার : জব ফেয়ারের নাম কিংবা ক্যারিয়ার ফেস্টের কথা অনেকের জানা। এসব জব ফেয়ার কিংবা ক্যারিয়ার ফেস্টের আয়োজন করে থাকেন বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানি কিংবা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে সিভি নেওয়ার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। আপনি চাইলে এখানে আপনার সিভি জমা দিয়ে চাকরি প্রত্যাশা করতে পারেন।
জাতীয় দৈনিক : আপনার হাতে একটি স্মার্টফোন থাকা মানে আপনি অনেক এগিয়ে। আপনি খোঁজ রাখতে পারেন দৈনিক জাতীয় পত্রিকাগুলোতে। যেখানে প্রায় সময় বিভিন্ন কোম্পানি চাকরির অফার কিংবা নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আর অবশ্যই নিয়োগটি সঠিক কিনা যাচাই করে নেবেন।
কর্পোরেট সেক্টরে যারা কাজ করে : আপনি যোগাযোগ রাখতে পারেন, আপনার আগে কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করা জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে। যাদের কাছ থাকে চাকরি সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাবে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও চাকরি পাওয়া যায়।
অ্যান্ড্রয়েড এ্যাপ্লিকেশন : বিভিন্ন অ্যাপে বর্তমান সময়ে চাকরি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘বিডিজবস ডটকম’। এখানে প্রতিদিন শত শত চাকরি বিষয়ক বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায়। এখানে আপনি একটি অ্যাকাউন্ট খুলে আপনার পছন্দমতো আপনার যোগ্যতার ভিত্তিতে আবেদন করতে পারেন। এছাড়া সাপ্তাহিক চাকরি বাজার অনলাইন প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিগুলো নোটিশ করে খোঁজ রাখুন। যদি মনে হয়, প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি আপনার যোগ্যতার মধ্যে, তাহলে আবেদন করুন।
কর্পোরেট চাকরির ভবিষ্যত : বলা যায়, কর্পোরেট চাকরির ভবিষ্যত খুবই ভালো এবং আশানুরূপ সাফল্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে তরুণের পছন্দের তালিকায় থাকে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে জব করা। বর্তমান সময়ে অনেক তরুণ বড় কোম্পানিতে জব করতে চায়। কারণ, এখানে স্যালারি ও সুযোগ-সুবিধা বেশি। তাই বলা যায়, কর্পোরেট চাকরির ভবিষ্যত ভালো। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন রকম ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হচ্ছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান। ফলে এ সেক্টরের ভবিষ্যত উজ্জ্বল বলাই চলে। সরকারি চাকরি নয়, বলা যায়- কর্পোরেট চাকরি এখন সোনার হরিণ। বর্তমান সময়ে এসে সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করে জীবনের অর্ধেক বয়স পার না করে, কর্পোরেট চাকরির জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি করে সাফল্য অর্জন করা যায়।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী