ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভূমিকম্প মোমিনের জন্য সতর্কবার্তা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ভূমিকম্প মোমিনের জন্য সতর্কবার্তা

গত ২১ নভেম্বর (শুক্রবার) বেলা সাড়ে ১০টার দিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূকম্প অনুভূত হয়। এর ধাক্কায় কয়েকজন নিহত হয়েছেন, কয়েকটি বিল্ডিং হেলে পড়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বেশ ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ শোনা গেছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে কঠিন শিলাত্বের চ্যুতি বা স্থানান্তরের কারণে ভূকম্পের উৎপত্তি। কিন্তু বিজ্ঞান যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক, ভূকম্প নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়; বরং সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা। এর মাধ্যমে তিনি বান্দাদের সতর্ক ও সাবধান করেন; যেন তারা তওবা করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং নিজেদের সংশোধন করে নেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই নিদর্শন পাঠাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৫৯)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘অবশ্যই আমি গুরুতর শাস্তির আগে লঘু শাস্তি দেব, যেন তারা ফিরে আসে।’ (সুরা সাজদা : ২১)।

ভূকম্প আল্লাহর সতর্কবার্তা : ভূকম্প মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা। মানুষ যেন নিজের অপরাধের জন্য তওবা করে, নিজের অনৈতিক আচার-আচরণ ঠিক করে নেয়, সার্বিক নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে, আল্লাহকে অনেক বেশি স্মরণ করে এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মানুষকে সতর্ক করে আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ‘জনপদের অধিবাসীরা কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আমার আজাব নিঝুম রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে থাকবে!’ (সুরা আরাফ : ৯৭)। বান্দার অপরাধ ক্ষমা প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে বিপদাপদই তোমাদের ওপর আসুক, তা তোমাদের হাতের কামাই। আল্লাহ তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শুরা : ৩০)।

ভূকম্প কেয়ামতের পূর্বাভাস : কেয়ামতের আগে কেয়ামতের অনেক ছোট-বড় লক্ষণ প্রকাশ পাবে। কিছু আলামত এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। ভূকম্প ও ভূমিধস কেয়ামতের অন্যতম নির্দশন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে পর্যন্ত ইলম তুলে না নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূকম্প না হবে, সময় সংকুচিত হয়ে না আসবে, ফেতনা প্রকাশ না পাবে এবং খুন-খারাবি বৃদ্ধি না পাবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি না পাবে যে, তা উপচে পড়বে, ততক্ষণ কেয়ামত হবে না।’ (বোখারি : ১০৩৬)।

ভূকম্পের বিভীষিকা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামত দিবসের ভূকম্পন হবে কঠিন। যেদিন তোমরা তা দেখবে, স্তন্যপায়ী মা তার দুগ্ধপোষ্য সন্তানের কথা ভুলে যাবে আর সব গর্ভবতীর গর্ভপাত হবে। মানুষকে মাতালের মতো দেখাবে, আসলে তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।’ (সুরা হজ : ১-২)।

ভূকম্প পাপ ও অপরাধের ফল : পৃথিবীতে যত বিপদাপদ ও বিপর্যয় নেমে আসে, কার্যত এগুলো মানুষের পাপ ও অপরাধের ফল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের ফলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ছে।

আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি দিতে চান, যেন তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে, আমানতের মাল লুটের মালে পরিণত হবে, জাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে, ধর্মবিবর্জিত শিক্ষার প্রচলন হবে, পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হবে, অথচ নিজ মায়ের অবাধ্য হবে, বন্ধুবান্ধবকে কাছে টেনে নেবে, অথচ পিতাকে দূরে ঠেলে দেবে, মসজিদে হট্টগোল করবে, পাপাচারীরা গোত্রের নেতা হবে, নিকৃষ্ট লোক সমাজের কর্ণধার হবে, কোনো মানুষের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তাকে সম্মান দেখানো হবে, গায়িকাণ্ডনর্তকি ও বাদ্যযন্ত্রের বিস্তার ঘটবে, মদপান করা হবে, এ উম্মতের শেষ জমানার লোকেরা তাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের অভিসম্পাত করবে, তখন তোমরা অগ্নিবায়ু, ভূমিধস, ভূকম্প, চেহারা বিকৃতি ও পাথর বর্ষণের মতো শাস্তির এবং আরও লক্ষণের অপেক্ষা করবে, যা একের পর এক আসতে থাকবে, যেমন পুরোনো পুঁতির মালা ছিঁড়ে গেলে একের পর এক তার পুঁতি ঝরতে থাকে।’ (তিরমিজি : ২২১১)।

ভূকম্পে ৭ আমল ও করণীয় : ভূকম্প হলে ইসলাম আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে। যেমন-

এক. নামাজ আদায় : সূর্যগ্রহণ ও চদ্রগ্রহণের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে নামাজ আদায়ের সুন্নাহ প্রমাণিত। ভূকম্পও একই প্রকৃতির বিপদ ও ভয়াবহ বিপর্যয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ভূকম্পের সময় বসরায় নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। (সুনানে বাইহাকি : ৩/৩৪৩)। ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন, ইসহাক ও আবু সাওরের মাজহাব অনুযায়ী, ভূকম্পের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি চন্দ্র-সূর্যগ্রহণের মতো। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘মানুষদের জন্য তীব্র ঝড়, ঝঞ্ঝা বায়ু, ভূকম্প, উল্কাপাতের সময় কোনো জামাত ছাড়া একাকী নামাজ পড়া ভালো।’ (আল-মুগনি : ৩/৩৩২-৩৩৩)।

দুই. অনুশোচনা ও তওবা করা : ভূকম্পের সময় পাপ এবং অবাধ্যতার জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করা মুস্তাহাব। ভূকম্প আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ও সতর্কবার্তা। এর পেছনে তাঁর ইচ্ছা হলো, বান্দারা তাঁর কাছে ফিরে যাবে এবং অনুতপ্ত হয়ে পাপ ছেড়ে দেবে। কুফায় এক ভূকম্পের সময় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের রব তোমাদের তাঁর সন্তুষ্টির প্রতি ফেরাতে চান, তোমরা তাঁর সন্তুষ্টি অনুসন্ধানে এসো।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/৪৮)।

তিন. দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা : দোয়ার অর্থ আল্লাহকে ডাকা। ইমাম কুস্তালানি (রহ.) বলেন, ‘বজ্রপাত, প্রবল বাতাস এবং ভূমিধসের মতো ভূকম্পের সময় দোয়া ও ইস্তিগফার করা বাঞ্ছনীয়।’ (ইরশাদুস সারি ফি শরহি সহিহিল বোখারি : ২/২৫৭)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘?এগুলো আল্লাহর নিদর্শন, যা তিনি পাঠিয়ে থাকেন কারও মৃত্যু বা জন্মের জন্য নয়; বরং আল্লাহ তা দ্বারা তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন। কাজেই যখন তোমরা এমন কিছু দেখতে পাবে, তখন ভীতবিহ্বল অবস্থায় আল্লাহর জিকির, দোয়া ও ইস্তিগফারের দিকে অগ্রসর হবে। (বোখারি : ১০০০)। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) এ হাদিস দ্বারা সূর্যগ্রহণসহ যে কোনো বিপদে জিকির, দোয়া ও ইস্তিগফার মুস্তাহাব হওয়ার প্রমাণ গ্রহণ করেছেন। (ফাতহুল বারি ফি শরহি সহিহিল বোখারি : ২/৬৩৫)।

চার. তাকবির দেওয়া ও জিকির করা : আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসব নিদর্শন বা বিপদের সময় তাকবির দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। (বোখারি : ১০৪৪)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে জিকির করার কথা বলা হয়েছে। (মুসলিম : ৯০৭)। বিপদের সময় সংক্ষিপ্ত দোয়া বারবার পড়া মুস্তাহাব। যেমন- ‘ইয়া হাইয়ু! ইয়া কাইয়ুম! বি রহমাতিকা আস্তাগিস’। (তিরমিজি : ৩৫২২)। অথবা ‘আল্লাহ, আল্লাহ, রব্বি, লা উশরিকা বিহি শাইআ’ পড়া চাই। (সুনানে আবি দাউদ : ১৫২৫)। তবে ভূকম্পের সময় সবচেয়ে সুন্নাহসম্মত দোয়া হচ্ছে, ‘আউযু বি ওয়াজহিকা’ পড়া। (বোখারি : ৬৮১৫)। এর অর্থ- ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি’।

পাঁচ. সদকা করা : ভূকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা থাকা অপরিহার্য। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তার গভর্নরদের সিরিয়ার ভূকম্পের ক্ষতিপূরণে সদকার আদেশ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। তাতে তিনি সাধারণ জনগণকেও ভূকম্পের সময় দান-সদকা করতে উৎসাহিত করেছেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৮৪১৪)। তাই ভূকম্পের পর সদকা করা মুস্তাহাব।

ছয়. মানবতার মুক্তি : ভূকম্প মানবতার জন্য ভয়াবহ বিপদ, যা সূর্যগ্রহণের চেয়েও ভীতিকর। আসমা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) সূর্যগ্রহণের সময় দাস মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। (বোখারি : ৯৯৬)। ভূকম্পের সব বিধানে আলেমগণ চন্দ্র-সূর্যগ্রহণের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভূকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া জাতীয় নিষ্কৃতি। ফলে তার বিনিময় হচ্ছে জীবন রক্ষার বিনিময়। অতএব, ভূকম্প পরবর্তী সময়ে মানবতার প্রতি আরোপিত বাধ্যবাধতার পরিস্থিতি সহজতর করা ইসলামের শিক্ষা। দাস মুক্তির স্থলে বৈদেশিক ঋণমুক্তি, বন্দী বিনিময়, কারামুক্তি কিংবা ঋণমুক্তি ইত্যাদি মানবতার মুক্তির সমতুল্য।

সাত. সতর্কতা ও জরুরি বার্তা : ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে মদিনায় ভূকম্প হয়। বিছানাপত্র সব এলোমেলো হয়ে যায়। অথচ আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) নামাজরত ছিলেন, কিন্তু কিছুই টের পেলেন না। তারপর ওমর (রা.) জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ২/৪৭৩, সুনানে বাইহাকি : ৩/৩৪২)। ভূকম্প সম্পর্কে অবহিত করে জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়া মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়কালে মদিনায় কোনো ভূকম্প হয়নি। তবে তিনি চন্দ্র-সূর্যগ্রহণের সময় দ্রুত মসজিদে অগ্রসর হতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। (বোখারি : ১০৪৭)।

লেখক : মুফতি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত