
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও ওফাত দিবস কেন্দ্র করে আজ সারাদেশে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করছেন মুসলিম উম্মাহ। আজকের দিনটি পবিত্র ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সাঃ) নামে পরিচিত। ‘পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.)’ উপলক্ষ্যে গতকাল শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বাণীতে বলেছেন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুপম জীবনাদর্শ, সর্বজনীন শিক্ষা ও সুন্নাহর অনুসরণ আজকের এ দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বে শান্তি, ন্যায় এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে। ধর্মীয় ও পার্থিব জীবনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুমহান আদর্শ ও সুন্নাহ বিশ্ববাসীর জন্য উৎকৃষ্টতম অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এবং এর মধ্যেই মুসলমানদের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ, সফলতা ও শান্তি নিহিত রয়েছে।’
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাতের পবিত্র স্মৃতি বিজড়িত ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.) সারাবিশ্বের মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র ও মহিমান্বিত একটি দিন উল্লেখ করে এ উপলক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীসহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ তথা সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে সমগ্র মানবজাতির হেদায়েত ও নাজাতের জন্য প্রেরণ করেছেন। নবী করিম (সা.) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে নবী, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য কেবল রহমতরূপে প্রেরণ করেছি’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)। হজরত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় এসেছিলেন ‘সিরাজাম মুনিরা’ অর্থাৎ আলোকোজ্জ্বল প্রদীপরূপে। সব ধরনের কুসংস্কার, অন্যায়, অবিচার, দাসত্ব ও পাপাচারের অন্ধকার থেকে মানুষকে মুক্তি ও আলোর পথ দেখাতে শান্তি, প্রগতি ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তিনি।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আল্লাহর প্রতি অসীম আনুগত্য ও ভালোবাসা, অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অপরিমেয় দয়া ও মহৎ গুণের জন্য পবিত্র কুরআনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনকে বলা হয়েছে ‘উসওয়াতুন হাসানাহ্’ অর্থাৎ সুন্দরতম আদর্শ। তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য যে অনিন্দ্য সুন্দর অনুসরণীয় শিক্ষা ও আদর্শ রেখে গেছেন, তা প্রতিটি যুগ ও শতাব্দীর মানুষের জন্য মুক্তির দিশারী হিসেবে পথ দেখাবে।’ পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.) সকলের মাঝে বয়ে আনুক অপার শান্তি ও সমৃদ্ধি এই কামনা করে তিনি বলেন, ‘সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ঐক্য আরো সুসংহত হোক। মহানবী (সা.)-এর সুমহান জীবনাদর্শ লালন ও অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তি সুনিশ্চিত হোক-এ কামনা করি। আমিন।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে পোস্ট করা এক বাণীতে বলেছেন, ‘আমরা সবাই যেন নিজেদের জীবনে ‘মহানবী (স.)-এর শিক্ষা, আদর্শ ও ত্যাগের মহিমার প্রতিফলন ঘটাতে পারি।’
তারেক রহমান বলেন, ‘ঈদে মিলাদুন্নবী, এই দিনটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দুনিয়াতে আগমণের আনন্দ ও তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। যিনি মানবজাতিকে পরিশোধন করেন এবং তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোরআন ও কাজের কথা শিক্ষা দেন।’ তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা মানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর আগমণ দিবস মর্যাদাবান, গুরুত্ববহ এবং আনন্দের। আল্লাহ’র প্রতি ঈমান ও মানবতার পথপ্রদর্শনকারী মহানবীর ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভাবের দিন। তিনি সারা বিশ্বের জন্য রহমতস্বরুপ, আমাদের জন্য আল্লাহ’র পক্ষ থেকে সবথেকে বড় উপহার বা এহসান। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে দিয়েছেন মহিমান্বিত মর্যাদা। পৃথিবীতে মানুষ ইহজগত ও পরজগতের মুক্তির সন্ধান পায় এই দিনে। হযরত মুহম্মদ (স.)এর আবির্ভাব ছিল একটি আলোকিত বিস্ময়। মানবজাতি তাঁর আগমণে নিজেদের কল্যাণ ও শান্তির নিশ্চয়তা লাভসহ জগতের সমস্ত অন্যায়-অবিচার, কুসংস্কার, নির্যাতন-নিপীড়ন এবং বৈষম্যের ঘোর অন্ধকার যুগ থেকে নিস্কৃতি লাভের উপায় সন্ধান পায়। সেজন্যই তিনি হয়েছেন মানবতার মুক্তির দিশারী।’
তারেক রহমান বলেন, ‘মানুষ ন্যায় ও সৎ পথে চলার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত লাভ করে রাসুলের (সঃ) দেখানো পথে। নিজ যোগ্যতা, সততা, মহানুভবতা, সহনশীলতা, কঠোর পরিশ্রম, আত্মপ্রত্যয়, অসীম সাহস, ধৈর্য্য, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও অপরিসীম দুঃখ যন্ত্রনা ভোগ করে তিনি তাঁর ওপর অবতীর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের বাণী তথা তওহিদ প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব পালন করেন। অন্ধকারের যুগ তথা আইয়ামে জাহেলিয়াতের আমলে আইন, বিচার ও প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যভিচার-অনাচারের অরাজকতা বিরাজমান ছিল।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই সময় যার আগমণ হয়েছিল তিনি হলেন রহমাতুল্লিল আলামীন। তিনি আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূরীভূত করে ইসলাম কায়েমের মাধ্যমে সত্য, ন্যায়বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সমাজে অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত ও দুঃখী মানুষের সেবা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, পরমতসহিষ্ণুতা, দয়া ও ক্ষমার গুণ, শিশুদের প্রতি দায়িত্ব এবং নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী (স.)-এর আদর্শ অতুলনীয় এবং তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে স্বীকৃত।’ তারেক রহমান বলেন, ‘আমি আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের নিকট প্রার্থনা করি মহানবী (সঃ) এঁর শিক্ষা, আদর্শ ও ত্যাগের মহিমা আমরা সবাই যেন নিজেদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারি। আমি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুসলিম ভাই-বোনদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শেষ নবী সাইয়েদুল মুরছালিন হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জন্য অসংখ্য দরুদ ও তাঁর প্রতি সালাম জানাই।’
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানসহ সারা দেশে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।
পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান : পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন উপলক্ষে ইফার উদ্যোগে পক্ষকালব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা গতকাল শুক্রবার বাদ মাগরিব বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব সাহানে অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন।
১৫ দিনব্যাপী ওয়াজ মাহফিল : গতকাল ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিনব্যাপী বাদ মাগরিব বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ পূর্ব সাহানে ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে দেশবরেণ্য আলেমণ্ডওলামা বয়ান করবেন।
বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সেমিনার : বাংলাদেশ বেতারের সাথে যৌথ উদ্যোগে ৪ দিন মহানবী (সা.)-এর জীবন ও কর্মের ওপর সেমিনার বায়তুল মোকাররম মিলনায়তনে ধারণ করা হবে। পরবর্তীতে তা বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্রের ‘ক’ চ্যানেল ও এফএম ১০৬-এ রাত ১০টা ৫ মিনিট থেকে রাত ১০টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত প্রচার করা হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররম মিলনায়তনে দর্শকের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হবে।
সিরাত স্মরণিকা প্রকাশ : পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ১৪৪৭ হিজরি উদযাপন উপলক্ষে দেশবরেণ্য আলেম-ওলামা, ইসলামী স্কলার, লেখক, কবি ও গবেষকদের লেখা সমৃদ্ধ একটি আকর্ষণীয় সিরাত স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়।
মাসব্যাপী ইসলামী বইমেলা : পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে জাতীয় মসজিদের পূর্ব ও দক্ষিণ সাহানে মাসব্যাপী ইসলামী বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। এবার মেলা আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করবে। এতে মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান ও লেবাননের পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা অংশ নেবে। এবারের মেলা বৃহত্তর পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রায় ২০০টি স্টল স্থান পাচ্ছে। মেলা শুরু হবে ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে। মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে।
ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা : ঢাকা মহানগরীর স্কুল, কলেজ, আলিয়া ও কওমি মাদরাসা এবং সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের ৩টি গ্রুপে বিভক্ত করে ৭টি বিষয়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। বিষয়গুলো হলো কিরাত, আজান, হামদণ্ডনাত, রচনা, কবিতা, উপস্থিত বক্তৃতা ও আরবিতে খুতবা লিখন।
১৫-১৬ সেপ্টেম্বর ইসলামিক ফাউন্ডেশন আগারগাঁও কার্যালয়ে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। ১৮ সেপ্টেম্বর বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হবে। কিরাত মাহফিল, হামদণ্ডনাত ও রাসুল (সা.)-এর শানে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর : জাতীয় মসজিদের পূর্ব সাহানে ১১ সেপ্টেম্বর বাদ মাগরিব কিরাত মাহফিল, ১৭ সেপ্টেম্বর বাদ মাগরিব হামদণ্ডনাত ও ১৮ সেপ্টেম্বর বাদ আসর রাসুল (সা.)-এর শানে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করা হবে। এতে দেশের প্রখ্যাত কারি, কবি ও শিল্পীরা অংশ নেবেন।
দেশব্যাপী ওয়াজ মাহফিল ও ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন : ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সকল বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, ৫৬টি ইসলামিক মিশন ও ৮টি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিতে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে মহানবী (সা)-এর জীবন ও কর্ম সম্পর্কিত ওয়াজ মাহফিল এবং ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে।