শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে গত বৃহস্পতিবার ‘মহান মে দিবস’ পালিত হয়েছে। দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণমুক্ত কর্মস্থলের দাবিতে শ্রমিকরা সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নানা ধরনের স্লোগান তুলে ধরেন। মে দিবস কেন্দ্র করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, রাজনৈতিক দল বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনসহ নানা সংগঠন সভা-সমাবেশ করে। সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ ছিল। ঢাকা মহানগরীতে প্রায় সব হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ দেখা গেছে। তবে বয়স্ক শ্রমিকদের বয়স্ক ভাতার আওতায় আনা; শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থাসহ নয় দফা দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ক?রে? হস্তশিল্প, কারচুপি ও হ্যান্ড এমব্রয়ডারি শ্রমিক ফেডারেশন। দেশের শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৩০ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছে সম্মিলিত শ্রমিক ফেডারেশন। প্লাস্টিক, পলিথিন বর্জন করে পাটের তৈরি পণ্য ব্যবহারের আহ্বান জানায় ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন’।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে ‘মহান মে দিবস’ এবং ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস’ উপলক্ষে র্যালির আয়োজনে যোগ দিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, মালিক-শ্রমিক এক কাতারে দাঁড়ালেই সমাজের চিত্র বদলে যাবে। আর অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করছে। শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে প্রক্রিয়া শুরু করতে পেরেছে তাতে আন্তর্জাতিকভাবে একটি বড় প্রভাব সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও) বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করেন উপদেষ্টা। তিনি জানান, আইএলওতে গিয়ে দেখা গেছে গত ২০-৩০ বছরে শ্রমিকদের বেতনসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব নাজুক হয়ে গেছে। আরেকটু হলেই ব্যান করে দেওয়ার আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। বর্তমানে শ্রমিকদের অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করে চলেছে।
এদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে মহান মে দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের’ উদ্যোগে এক শ্রমিক সমাবেশে বক্তরা বলেছেন, মুক্তির কথা বলে এ দেশে একদল শ্রমিক সংগঠন প্রতারণার ফাঁদে ফেলে শ্রমিকদের বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে চলেছে। তারা শুধু মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে। মালিক শ্রেণির সেবাদাস সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তুলতে নিরুৎসাহিত করে। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘পুঁজিবাদী শোষণ-বৈষম্যে অবসানের লক্ষ্যে সংগ্রাম করতে হবে। মজুরি দাসত্ব উচ্ছেদের এই লড়াই জোরদার করতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের মঞ্চে হাজির হতে হবে শ্রমিকদের। জুলাই অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল আয়োজিত শ্রমিক গণসমাবেশে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার উচ্ছেদে জুলাই আন্দোলনে শ্রমিক-জনতা ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে সংগ্রামকে বিজয়ের দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান শেষে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের সরকার হয়নি। শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা কায়েম হয়নি। ফ্যাসিস্ট সরকার উচ্ছেদ হয়ে গেলেও ফ্যাসিবাদের ভিত্তি– লুটেরা, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ শাসক শ্রেণি অক্ষত রয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
যেসব খাত এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে : টাইপ ফাউন্ড্রি (৫২১ টাকা), পেট্রলপাম্প (৭৯২), বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান (৩,০০০), হোটেল ও রেস্তোরাঁ (৩,৭১০), লৌহ ঢালাই ও ওয়ার্কশপ (৪,২৪০), আয়ুর্বেদিক (৪,৩৫০), ম্যাচ কারখানা (৪,৫৬০), পাট প্রেস (৪,৮৫০), দর্জি কারখানা (৪,৮৫০), তুলা টেক্সটাইল (৫,৭১০), এবং বেকারি ও বিস্কুট কারখানাসহ (৫,৯৪০) মোট ২২টি খাতের শ্রমিক এই সীমার নিচে মজুরি পান।
যেসব খাত তুলনামূলক ভালো মজুরি দিচ্ছে : আবার, যেসব খাতে মজুরি দারিদ্র্যসীমার ওপরে রয়েছে সেগুলো হলো- ওষুধ শিল্প (৮,০৫০), প্লাস্টিক ও বেসরকারি পাটকল (৮,০০০), ছাপাখানা (৮,১৫০), কাঁচ ও সিলিকেট (৮,৫০০), অ্যালুমিনিয়াম (৮,৭০০), নিরাপত্তা সেবা (৯,১৪০), মৎস্য (১০,৫২০), বেসরকারি সড়ক পরিবহন (১০,১০০), রি-রোলিং মিল (১০,৬৫০), হোমিওপ্যাথিক (১১,৫০০), পোশাক (১২,৫০০), ট্যানারি (১২,৮০০), এবং করাতকল (১৭,৯০০)।
চার দশকেও হয়নি মজুরি পরিবর্তন : টাইপ ফাউন্ড্রির মজুরি সর্বশেষ নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে, পেট্রলপাম্পে ১৯৮৭ সালে, আয়ুর্বেদিক ২০০৯, লৌহ ঢালাই ২০১০, লবণ কারখানা ২০১১, ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রি ২০১৩, হোটেল-রেস্তোরাঁ ২০১৬ সালে। আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছরে মজুরি পুনর্বিন্যাস বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে তা হয়নি।
জাতীয় ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব : শ্রম সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে, যা সব খাত, সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি সংস্থা এবং স্বনিয়োজিতদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এছাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতি তিন বছর অন্তর মজুরি পুনর্বিন্যাসের। একইসঙ্গে খাতভিত্তিক মজুরি কখনোই জাতীয় ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম না হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
শ্রমিকদের চার দফা দাবি : বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের মতে, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে চারটি প্রধান দাবি রয়েছে। এরমধ্যে প্রথম- শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন। দ্বিতীয়- ন্যূনতম মজুরি ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ। তৃতীয়- আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী শ্রম আইন সংস্কার এবং চতুর্থ- সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা চালু।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দারিদ্রসীমার নিচে মজুরি নির্ধারণ চরম অমানবিক। একটি পরিবার পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ আয় প্রয়োজন, সেটি হিসেব করে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। অন্তত ২০ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত।