ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মৎস্য আহরণ ও ফল রপ্তানিতে সহায়তা দেবে এফএও

* বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা * বাংলাদেশি কমিউনিটিকে সহায়তা দেওয়ায় রোমের মেয়রকে প্রধান উপদেষ্টার ধন্যবাদ * জিবুতির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠক
মৎস্য আহরণ ও ফল রপ্তানিতে সহায়তা দেবে এফএও

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক ড. কু দোংইউ বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ শিল্পের উন্নয়ন ও কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে ফল রপ্তানি বাড়াতে অব্যাহত সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। রোমে এফএও সদর দপ্তরে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম এবং সংস্থাটির ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিনি এ আশ্বাস দেন।

বৈঠকের শুরুতে ড. কু অধ্যাপক ইউনূসকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং বাংলাদেশের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে তাঁর ব্যাপক অবদানের প্রশংসা করেন।

বাংলাদেশকে ‘উচ্চ সাফল্য অর্জনকারী দেশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এফএও মহাপরিচালক বলেন, সংস্থাটি প্রযুক্তিগত সহায়তা, উদ্ভাবন এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিমুখী সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের সহায়তা অব্যাহত রাখব।’

প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এফএও’র দীর্ঘদিনের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনটি নতুন ক্ষেত্রে সহায়তা চান—গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে সক্ষমতা বৃদ্ধি, ফল রপ্তানি সম্প্রসারণে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ উন্নয়ন এবং ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা জোরদার করা, যার মধ্যে সাশ্রয়ী ও বহনযোগ্য কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন অন্তর্ভুক্ত।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের পুরো সমুদ্র রয়েছে, কিন্তু আমরা মাছ ধরি অগভীর জলে। আমরা কখনোই সামুদ্রিক সম্পদ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারিনি। বিদেশি ট্রলারগুলো আমাদের জলসীমায় মাছ ধরে, অথচ আমরা পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত নই।’

এর জবাবে ড. কু পরামর্শ দেন, বাংলাদেশ যেন চীনের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়ে গভীর সমুদ্রের মাছের মজুদ নিরূপণ ও টেকসই আহরণ কৌশল প্রণয়নে সহায়তা নেয়।

বাংলাদেশের ফল রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের আম, কাঁঠাল ও পেয়ারা আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তিনি ছোট কৃষকদের ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমাতে মোবাইল কোল্ড স্টোরেজ নকশার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন। ড. কু বলেন, উচ্চমূল্যের নগদ ফল উৎপাদন কৃষি খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানান, ১৯৮০-এর দশকে জাপানে ফল রপ্তানির মাধ্যমে চীন কৃষি উন্নয়নে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছিল।

আগামী দিনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৬ সালে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ২০ বছর পূর্ণ হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা তা উদযাপন করব,’—বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে এ কথা বলেন তিনি।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম।

বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা: ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, এ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।

রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের (ডব্লিউএফএফ) ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্টের ফাঁকে সোমবার (রোম সময়) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে এ আগ্রহ প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট লুলা।

ফোরামে উভয় নেতা প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখার পর এফএও সদর দপ্তরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে তারা পারস্পরিক আগ্রহের নানা বিষয়ে আলোচনা করেন, যার মধ্যে ছিল সামাজিক ব্যবসা, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং দারিদ্র্য মোকাবিলার কৌশল।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রেসিডেন্ট লুলাকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। প্রেসিডেন্ট লুলা আমন্ত্রণ গ্রহণ করে জানান, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তিনি বাংলাদেশ সফর করতে চান। ‘আমি বাংলাদেশে যাবো,’ বলেন প্রেসিডেন্ট লুলা। তিনি বলেন, ব্রাজিল তার নাগরিকদের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করতে চায় এবং সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে আগ্রহী। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, ‘এটি হবে অসাধারণ’।

দুই নেতা গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ, ফার্মাসিউটিক্যালস—বিশেষত টিকা পেটেন্টমুক্ত ও সাশ্রয়ী করার উদ্যোগ—এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পদক্ষেপ নিয়ে সহযোগিতার সুযোগ নিয়েও আলোচনা করেন। এছাড়া ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের তরুণদের নেতৃত্বে সংঘটিত আন্দোলনের প্রসঙ্গও উঠে আসে।

বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস তাঁর ব্রাজিল সফরের স্মৃতিচারণ করেন, যার মধ্যে ছিল ২০০৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে দেশটির বিভিন্ন শহর পরিদর্শন।

প্রেসিডেন্ট লুলা অধ্যাপক ইউনূসকে আগামী বছর অ্যামাজন অঞ্চলে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান, যাতে বিশ্বের বৃহত্তম উষ্ণমণ্ডলীয় অরণ্য রক্ষার লড়াইয়ে বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়।

প্রধান উপদেষ্টা আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি হয়তো কপ৩০-এ অংশ নিতে পারবেন না, কারণ আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে তিনি ব্যস্ত থাকবেন।

তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচন হবে বাংলাদেশের জন্য একটি ‘বাস্তব ও ঐতিহাসিক’ মুহূর্ত। কারণ এটি হবে গত ১৬ বছরে দেশের প্রথম সুষ্ঠু নির্বাচন। তিনি বলেন, অতীতে স্বৈরশাসকের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো ছিল ‘ভুয়া ও কারচুপিপূর্ণ’।

প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ ও ব্রাজিলের মধ্যে বাণিজ্য এবং সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন।

বৈঠকের এক পর্যায়ে দুই নেতা ফুটবলকে বৈশ্বিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন। অধ্যাপক ইউনূস হাস্যরসের সুরে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে ব্রাজিল ফুটবল দলের অসংখ্য সমর্থক রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই মানুষ ব্রাজিলকে সমর্থন করে।’

বৈঠকে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ব্রাজিলের কয়েকজন মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও অংশ নেন।

বাংলাদেশি কমিউনিটিকে সহায়তা দেওয়ায় রোমের মেয়রকে প্রধান উপদেষ্টার ধন্যবাদ:

ইতালিতে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটিকে সহায়তা দেয়ার জন্য রোমের মেয়র রবার্তো গুয়ালতিরিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি বলেন, ইতালিতে বাংলাদেশিরা দেশটির সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে এখানকার সমাজ ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। গত সোমবার রোম সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়ে রোমের মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশি অভিবাসীদের এত সুন্দরভাবে দেখভাল করার জন্য ধন্যবাদ।’

তিনি বলেন, ইতালিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা ইতালির অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছেন, তেমনি দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করছেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তারা এখন এখানকার সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছেন। ইতালির শীর্ষ রেস্তোরাঁগুলোর অনেক রাঁধুনিই বাংলাদেশি।’

রোমের মেয়র গুয়ালতিরিও রোমের বহুসাংস্কৃতিক সমাজে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসা করেন।

তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁর কার্যালয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। ঐতিহাসিক রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের মাঝে অবস্থিত এ কার্যালয় জুলিয়াস সিজারের আমলের নিদর্শনের অংশ।

মেয়র গুয়ালতিরি প্রধান উপদেষ্টাকে প্রাচীন রোমান সেনেট ভবন ও আশপাশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ঘুরে দেখান।

বৈঠক শেষে তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে একটি স্মারক ফলক উপহার দেন। ফলকটিতে খোদাই করা আছে রোমান সম্রাট ও দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াসের প্রতিকৃতি। সম্প্রতি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভাসহ কয়েকজন বিশ্বনেতাকেও এ স্মারক প্রদান করা হয়েছে।

দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দুই নেতা বিশেষত রোমে বর্তমানে বসবাসরত ৫০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির উপস্থিতির প্রেক্ষাপটে রোম ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও জোরদারের গুরুত্বের ওপর জোর দেন।

বৈঠকে উভয়ে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, নিরাপদ অভিবাসন এবং ভবিষ্যতে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করেন।

বৈঠকে এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং ইতালিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রকিবুল হক উপস্থিত ছিলেন।

জিবুতির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠক: ইতালির রাজধানী রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের (ডব্লিউএফএফ) অনুষ্ঠানের ফাঁকে গত সোমবার জিবুতির প্রধানমন্ত্রী আবদুল কাদের কামিল মোহাম্মেদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত