ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গাজায় ১০০ জনকে হত্যার পর আবার যুদ্ধবিরতি

* গাজা-গণহত্যায় জড়িত ষাটেরও বেশি দেশ, জাতিসংঘে বিস্ফোরক প্রতিবেদন * সেনা সদস্যদের আত্মহত্যার ভয়াবহ তথ্য ফাঁস, বিপাকে ইসরায়েল
গাজায় ১০০ জনকে হত্যার পর আবার যুদ্ধবিরতি

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে ব্যাপক হামলা চালিয়ে প্রায় ১০০ জনকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরায়েল। গতকাল বুধবার থেকে তারা যুদ্ধবিরতি পুনরায় কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে। মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে এক পোস্টে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশনার পর সেনাবাহিনী যুদ্ধবিরতি চুক্তি পুনরায় কার্যকর করেছে।

বিবৃতিতে দখলদাররা বলেছে, তারা গাজার প্রায় ৩০ জায়গায় হামলা চালিয়েছে। এতে হামাসের অবকাঠামো ও যোদ্ধাদের লক্ষ্য করা হয়েছিল বলেও জানায় তারা। এরআগে গতকাল রাতে গাজায় ‘তাৎক্ষণিক’ ও ‘শক্তিশালী’ হামলা চালানোর নির্দেশ দেন যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ওইদিন বিকালে রাফাতে এক ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়। তবে তার ওপর কে বা কারা হামলা চালিয়েছিল সেটি নিশ্চিত নয়। ওই সেনার মৃত্যুর পর ইসরায়েল দাবি করে হামাস যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এছাড়া মৃত জিম্মিদের মরদেহ সময়মতো ফেরত না দিয়ে হামাস চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলেও দাবি করে তারা। এরপরই রাতে গাজায় ব্যাপক হামলার নির্দেশ দেন নেতানিয়াহু। তার নির্দেশের কয়েক ঘণ্টা পর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজায় এসে ব্যাপক বোমাবর্ষণ শুরু করে। এতে এক পরিবারের ১৮ জনসহ প্রায় ১০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি কার্যকর ঘোষণা করলেও হামাস এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। গত মঙ্গলবার নেতানিয়াহু হামলার নির্দেশ দেওয়ার পর স্বাধীনতাকামী এ সশস্ত্র গোষ্ঠী জানায়, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন করায় তারা জিম্মিদের মরদেহ হস্তান্তর স্থগিত করেছে।

গাজা-গণহত্যায় জড়িত ষাটেরও বেশি দেশ, জাতিসংঘে বিস্ফোরক প্রতিবেদন : দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পেশ করা এক নতুন প্রতিবেদনে বলেছেন, পশ্চিমা শক্তি এবং কিছু আরব রাষ্ট্রসহ ষাটেরও বেশি দেশ গাজায় ইসরাইলের ‘গণহত্যার যন্ত্র’ সচল রাখতে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। মঙ্গলবার তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের ডেসমন্ড অ্যান্ড লিয়া টুটু লেগাসি ফাউন্ডেশন থেকে ভিডিও সংযোগের মাধ্যমে সাধারণ পরিষদে তার ২৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তার এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘গাজা গণহত্যা: এক যৌথ অপরাধ’।

আলবানিজ বলেন, এই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে কীভাবে এসব দেশ চোখ বুজে থেকেছে, যখন গাজার দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে বোমা হামলা, অনাহার ও অবরোধের মাধ্যমে ধ্বংস করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ওয়াশিংটন ও বার্লিন থেকে শুরু করে লন্ডন ও তারও বাইরে পর্যন্ত সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক যোগসাজশের এক বিশাল জাল বিস্তৃত’।

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি একে ‘বর্ণবৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের প্রতীকী কেন্দ্র থেকে দেওয়া এক সাক্ষ্য’ বলে বর্ণনা করেন। আলবানিজ বলেন, বিশ্বশক্তিগুলো ‘ইসরাইলের সামরিকায়িত বর্ণবৈষম্যের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, রক্ষা করেছে এবং শক্তিশালী করেছে’। যার ফলাফল হলো এই গণহত্যা, যা ফিলিস্তিনের আদিবাসী জনগণের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অপরাধ’। জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত বলেন, সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর পাঠানো অস্ত্র, প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্য ইসরাইলকে গাজায় ‘শ্বাসরুদ্ধ, অনাহারে নিপতিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত’ অবস্থায় নিয়ে এসেছে।

সহযোগিতার ক্ষেত্র : ফ্রান্সেসকা আলবানিজের এই প্রতিবেদনে ইসরাইলের যুদ্ধ অর্থনীতির কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশটি ইসরাইলের অস্ত্র আমদানির দুই-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সাতবার ভেটো প্রয়োগ করে ইসরাইলকে দায়মুক্তি দিয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জার্মানি, ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশও উন্নত অস্ত্র সরবরাহ করেছে, যদিও ‘গণহত্যার প্রমাণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল’। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিচারিতারও সমালোচনা করে বলেন, ‘ইইউ রাশিয়ার বিরুদ্ধে দ্রুত নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে, কিন্তু ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্যে তারা এখনো প্রধান অংশীদার— এটি মানবিক সহায়তাকে অস্ত্রে পরিণত করার এক উদাহরণ’।

আলবানিজ উল্লেখ করেন, গাজার ওপর প্রায় সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে ইসরাইল যে নৃশংসতা চালিয়েছে, ইউরোপীয় দেশগুলোর সহযোগিতা সেটিকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে।

আরব সহযোগীদের ভূমিকা : এই প্রতিবেদনে আরব দেশগুলোকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। আলবানিজ বলেন, ‘গাজা জ্বলতে থাকলেও’ কিছু আরব রাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। তিনি বিশেষভাবে মিশরের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, দেশটি ‘ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা ও জ্বালানি সহযোগিতা বজায় রাখছে এবং রাফাহ সীমান্ত বন্ধ রেখেছে’— যা গাজার শেষ মানবিক জীবনরেখাটিকেও চেপে ধরছে।

নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা : অস্ত্র, বাণিজ্য ও কূটনীতির বাইরেও আলবানিজ বলেন, ‘জাতিসংঘ ও বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর দশকের পর দশকের নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা’ এই গণহত্যাকে বাস্তব সময়ে ঘটতে দিয়েছে— এমনকি সরাসরি সম্প্রচারিত হলেও তা থামাতে বিশ্ব ব্যর্থ। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘বিশ্ব এখন এমন এক সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে— যা আইনের শাসনের পতন ও ন্যায়ের পুনর্জাগরণের মধ্যবর্তী এক ছুরির ধারালো প্রান্ত’। আলবানিজ বলেন, ‘পুনর্জাগরণ তখনই সম্ভব, যখন যোগসাজশের মুখোমুখি হওয়া হবে, দায় স্বীকার করা হবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে’।

ইসরাইলি দূতের উন্মত্ত প্রতিক্রিয়া : এদিকে আলবানিজের বক্তব্যের পরই জাতিসংঘ অধিবেশন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কারণ ওই সময় ইসরাইলি দূত ড্যানি দানন ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে তাকে ‘দুষ্ট ডাইনি’ বলে গালিগালাজ করেন। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা তার এই আক্রমণকে ‘অশোভন ও লজ্জাজনক’ বলে নিন্দা জানিয়ে বলেন, এটি দেখায় যে— ‘স্বাধীন জাতিসংঘভুক্ত কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করার মরিয়া চেষ্টা চলছে’। এদিকে মৌখিক আক্রমণের জবাবে অবিচল আলবানিজ বলেন, ‘যদি আপনারা আমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হিসেবে জাদুবিদ্যার কথা বলেন, আমি তা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যদি সত্যিই আমার কোনো মন্ত্রশক্তি থাকত, আমি তা ব্যবহার করতাম আপনাদের অপরাধ থামাতে এবং দায়ীদের শাস্তি দিতে’। তিনি বক্তব্য শেষে রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ইসরাইলের সঙ্গে সব সামরিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্থগিত করার আহ্বান জানান, বিশেষ করে দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য পণ্য আদান-প্রদান, যা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে। আলবানিজ বলেন, ‘সময় এসেছে— কিছু মানুষের নয়, বরং সবার মর্যাদা ও অধিকারের ওপর ভিত্তি করে এক জীবন্ত কাঠামো গড়ে তোলার’।

এদিকে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা তার এই প্রতিবেদনকে গাজার যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে কঠোর ও স্পষ্ট অভিযোগপত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সেনা সদস্যদের ভয়াবহ তথ্য ফাঁস, বিপাকে ইসরাইল : ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অন্তত ৫০ সেনা সদস্যের আত্মহত্যা এবং ২৭৯ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়ে এসব ঘটনা ঘটে বলে নতুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরাইলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এসেছে।

ইসরাইলি পার্লামেন্ট নেসেটের রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টার মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, প্রতি একজন সেনা যে আত্মহত্যায় প্রাণ হারিয়েছেন, তার বিপরীতে আরও সাতজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। খবর প্রেস টিভির। প্রতিবেদনটি আরও জানায়, ২০২৪ সালে আত্মহত্যার ঘটনার প্রকৃতিতে একটি বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। সেই বছর আত্মহত্যাকারীদের ৭৮ শতাংশ ছিলেন যুদ্ধরত সেনা। যেখানে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এই হার ছিল মাত্র ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই হার বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজায় ইসরাইলের ব্যাপক রিজার্ভ সৈন্য সমাবেশ। যেখানে হাজার হাজার সেনাকে পুনরায় সক্রিয় ডিউটিতে ডাকা হয়।

প্রতিবেদনে ব্যবহৃত অধিকাংশ তথ্য এসেছে ইসরাইলি সামরিক মেডিক্যাল কর্পসের মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং নেসেটের বিভিন্ন কমিটিতে অনুষ্ঠিত আলোচনাগুলো থেকে। প্রতিবেদনটি স্পষ্ট করে বলেছে, এই পরিসংখ্যান শুধু সেই সেনাদের অন্তর্ভুক্ত করেছে, যারা আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টার সময় সক্রিয় বা রিজার্ভ ডিউটিতে ছিলেন— অবসরে গিয়ে আত্মহত্যা করা প্রাক্তন সেনাদের এ তালিকায় তুলে ধরা হয়নি। প্রতিবেদনটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন ইসরাইলি সেনা আত্মহত্যা করে প্রাণ হারিয়েছেন। এর, আগের রিপোর্টগুলো থেকেও জানা গেছে, গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অন্তত ৪৩ জন ইসরাইলি সেনা আত্মহত্যা করেছেন। চলতি বছরের জুলাই মাসে ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো জানায়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রায় চার ডজন সেনা আত্মহত্যা করেছেন। যারা গাজার যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়াবহ সহিংসতা ও মানসিক আঘাতের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। যদিও ইসরাইলি সেনাবাহিনী এসব আত্মহত্যার ঘটনা এবং তার প্রেক্ষাপট গোপন রাখার চেষ্টা করছে, তবু একের পর এক তথ্য ফাঁস হয়ে সামনে আসছে— যা এই সংকটের তীব্রতা ও ব্যাপকতা তুলে ধরছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত