
প্লাস্টিক দূষণে বিপর্যস্ত পরিবেশকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছে পটুয়াখালীর দুমকির এক তরুণ উদ্যোক্তা। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য সুপারি খোলকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব প্লেট, বাটি ও চামচ তৈরি করে আলোচনায় এসেছে আলপথ লিমিটেড। মাত্র ২৮ বছর বয়সে গ্রামের অবহেলিত অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন উদ্যোক্তা তৌকির আহম্মেদ। পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত।
বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক বর্জ্য এখন পরিবেশের জন্য এক ভয়ংকর হুমকি। নদীনালা, খালবিল থেকে শুরু করে গ্রাম-শহরের প্রতিটি স্তরে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব স্পষ্ট। ঠিক এমন সময় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের দুমকি উপজেলায় সুপারি খোল দিয়ে তৈরি একাধিকবার ব্যবহারযোগ্য পণ্য তৈরির উদ্যোগ আশা জাগিয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। দুমকি উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের রাজাখালী এলাকায় নির্মিত এই কারখানায় সুপারি খোল প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের প্লেট, বাটি ও চামচ, যা প্লাস্টিকের সরাসরি বিকল্প হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যই সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব, বায়োডিগ্রেডেবল এবং নিরাপদ। ফলে দাওয়াত, অনুষ্ঠান বা রেস্টুরেন্টে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে এসব পণ্যের চাহিদা তৈরি হচ্ছে দ্রুত। তরুণ উদ্যোক্তা তৌকির আহম্মেদ দুমকি উপজেলার খাতিব আহম্মেদ কামবারের একমাত্র ছেলে। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফাহাদ মেহেদী ও আমান সুজয়কে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে বসেই কর্মসংস্থান তৈরির বড় স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করেছেন।
স্থানীয়ভাবে সুপারি চাষের জনপ্রিয়তা দেখে তারা ভাবেন, সুপারি খোলকে শিল্পজাত কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু করা যায় কি না। সেই ভাবনা থেকেই যাত্রা শুরু আলপথ লিমিটেডের। আজ যার পণ্য বাজারে যেমন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তেমনি তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে তৌকির আহম্মেদ বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব দেখে বিকল্প কিছু ভাবতে গিয়ে সুপারি খোল দিয়ে পণ্য তৈরির ধারণা আসে। এখন এই কারখানা দুমকির মানুষকে যেমন কাজে যুক্ত করেছে, তেমনি পরিবেশ রক্ষায়ও অবদান রাখছে। উদ্যোগটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে নারীরা ঘরে বসেই উপার্জনের সুযোগ পাচ্ছেন। বর্তমানে কারখানাটিতে কাজ করছেন প্রায় ২০ জন নারী ও পুরুষ।অনেক নারী প্রথমবারের মতো বেতনভুক্ত কাজে যুক্ত হয়ে নিজের পরিবারে আর্থিক সহযোগিতা করতে পারামাত্রই নতুন আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছেন।
স্থানীয় নারী শ্রমিকরা বলেন, আগে ঘরে বসে সময় কাটত। এখন নিজ হাতে টাকা উপার্জন করতে পারছি। পরিবার যেমন আমাদের সম্মান করছে, তেমনি নিজেরাও আত্মনির্ভর হতে পারছি।আলপথ লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, দেশের বাজারে চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই খুব শিগগিরই বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর কাজ চলছে।
উৎপাদন লাইন বাড়ানোর পাশাপাশি নারী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন, নতুন ডিজাইনের পণ্য যুক্ত করা এবং বাজার সম্প্রসারণ নিয়েও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। দুমকি উপজেলা প্রশাসন এই উদ্যোগকে এলাকাভিত্তিক সবুজ শিল্প উন্নয়নের মডেল হিসেবে দেখছে। প্রশাসনের দাবি এই উদ্যোগ গ্রামীণ উন্নয়ন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুজর মো. ইজাজুল হক বলেন, স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দুমকির এই কারখানা ভবিষ্যতের সবুজ শিল্পায়নের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। পরিবেশ রক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্থানীয় শিল্পের বিকাশ সব দিক মিলিয়ে তৌকির আহম্মেদদের এই উদ্যোগ এখন দুমকির গর্ব।
স্থানীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব শিল্প গড়ে তোলার এই মডেল দেশের অন্যান্য এলাকাতেও নতুন অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে সবুজ ভবিষ্যতের পথে উজ্জ্বল এক উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আলপথ লিমিটেড।