প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ আগস্ট, ২০২৫
আল্লাহর সৃষ্টিরাজির সর্বত্রই রয়েছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। বিচিত্র সব সৃষ্টিতে নিপুণভাবে সাজানো এ বসুন্ধরা। প্রাণিজগৎ, উদ্ভিদ ও জড়জগৎ সবখানেই ছড়িয়ে আছে রূপ ও বর্ণের বিচিত্রতা। কোরআনে এসেছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য রং-বেরঙের যে বস্তুরাজি পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা তাঁর নির্দেশে কর্মরত। নিশ্চয় যারা শিক্ষা নেয়, সেসব লোকের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নাহল : ১৩)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘পাহাড়ের মধ্যেও আছে বিচিত্র বর্ণের অংশ- সাদা, লাল ও নিকষ কালো।’ (সুরা ফাতির : ২৭)।
মানুষ ও প্রাণিজগতে বৈচিত্র্য : মানুষ আল্লাহর অন্যতম বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি। পৃথিবী সৃষ্টির পর এ পর্যন্ত আল্লাহ অসংখ্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন। একই উপাদানে সৃষ্ট সব মানুষ। তবুও রূপে-গুণে, আকারে-বৈশিষ্ট্যে একজন অপরজন থেকে ভিন্ন। সম্পূর্ণ অভিন্ন দুটি মানুষ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিটি নবজাতকই কোনো না কোনো বৈচিত্র্য নিয়ে জন্মে। আল্লাহ মানুষকে মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাকশক্তি দিয়েছেন। কিন্তু সুর-স্বর, বাচনভঙ্গি ও উচ্চারণের বিচারে প্রত্যেকের কথার ধরন ভিন্নœ। ভাষারও যে কত রূপ-প্রকৃতি, তা বলাবাহুল্য। বর্তমান পৃথিবীতে শুধু রাষ্ট্রীয় ভাষাই আছে দুই শতাধিক। জানা না থাকলে এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষার মানুষের কোনো কথাই বুঝতে পারে না। একই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেও অঞ্চলভেদে ভাষার কত বিস্তর পার্থক্য! এসব কিছু মহান সৃষ্টিকর্তার বিচিত্র নিদর্শন। যার কুদরত অপরিসীম। তারপরও কি মানুষ তাদের চিন্তাশক্তি কাজে লাগাবে না! উপদেশ গ্রহণ করবে না! আল্লাহ বলেন, ‘(আল্লাহর) নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানবানদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।’ (সুরা রুম : ২২)। অন্যান্য জীবজন্তুর মধ্যেও রয়েছে বর্ণ-বৈচিত্র্য। আল্লাহ জলে-স্থলে কত শত আকৃতি ও প্রজাতির প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ, পশু ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও আছে অনুরূপ বর্ণ-বৈচিত্র্য।’ (সুরা ফাতির : ২৮)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘তিনি গবাদিপশুর মধ্যে (সৃষ্টি করেছেন) কিছু ভার বহনকারীরূপে আর কিছু খর্বাকৃতির।’ (সুরা আনআম : ১৪২)।
বহুমুখী কল্যাণের ধারক : আল্লাহ প্রাণিজগৎকে বহুমুখী কল্যাণের ধারক বানিয়েছেন। যেমন-
বাহন : পৃথিবীতে প্রাণী হিসেবে বাহন সর্বপ্রাচীন। এখনও পৃথিবীর বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রাণীকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাদের ভার বহন করে নিয়ে যায় এমন দেশে, যেখানে প্রাণান্ত কষ্ট ছাড়া তোমরা পৌঁছাতে পারতে না। তোমাদের প্রতিপালক অবশ্যই দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’ (সুরা নাহল : ৭)।
পানাহারের উৎস : প্রাণিজগৎ মানবজাতির খাবার ও পানীয় জোগান দিয়ে থাকে। কোরআনে এসেছে, ‘আমি এগুলোকে তাদের বশীভূত করে দিয়েছি। এগুলোর কিছু তাদের বাহন ও তাদের অনেকে আহার করে। তাদের জন্য এগুলোতে আছে বহু উপকারিতা; আছে পানীয় বস্তু। তবু কি তারা কৃতজ্ঞ হবে না?’ (সুরা ইয়াসিন : ৭২-৭৩)।
পোশাকের উৎস : প্রাণী থেকে মানুষ পোশাক তৈরির উপাদান সংগ্রহ করে। যেমন- পশম, চামড়া, রেশমগুটি ইত্যাদি। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জন্য তাতে শীত নিবারক উপকরণ ও বহু উপকার আছে। তা থেকে তোমরা আহার করে থাক।’ (সুরা নাহল : ৫)।
মানসিক প্রশান্তি : পশুপাখি মানুষের চোখ শীতল করে এবং মনে প্রশান্তি আনে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যখন সন্ধ্যায় তাদের চারণভূমি থেকে ঘরে নিয়ে আস এবং সকালে যখন তাদের চারণভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তোমরা তাঁর সৌন্দর্য উপভোগ কর।’ (সুরা নাহল : ৬)।
উদ্ভিদজগতের বৈচিত্র্য : আল্লাহর সৃষ্ট উদ্ভিদজগতেও রয়েছে বিচিত্র সমাহার। ভূবনজুড়ে রকমারি গাছপালা, তরুলতা, ফল-ফলাদি, পুষ্পরাজি, শস্য ও ফসলাদি সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অনন্য ও বিস্ময়কর বৈচিত্র্য। এসবের কোনোটা মাচায় চড়ানো থাকে, কোনোটা মজবুত কাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আর কিছু হলো লতানো গাছ, যেগুলো মাটিতে ছড়িয়ে যায়। তিনি সৃষ্টি করেছেন কত রকমের ফলমূল! প্রত্যেক প্রকার ফলের স্বাদ ও ঘ্রাণ যেমন ভিন্ন, উপকারিতাও একেক রকম। আবার ফুলবাগানে ও জঙ্গলে ফুটে থাকে কত হাজারো রকমের রঙ-বেরঙের ফুল! প্রতিটা ফুলের কী অপূর্ব ঘ্রাণ, মনমাতানো সৌরভ। তিনি আমাদের জন্য কত শত প্রকারের শস্য ও সবজি সৃষ্টি করেছেন। সেগুলো খেয়ে আমাদের কত রকম উপকার হয়। সবগুলো একই পানি, একই মাটি ও বাতাস, একই আবহাওয়ায় উৎপন্ন; তবুও প্রতিটির মধ্যে কত বিস্তর পার্থক্য।
আল্লাহ চান, বান্দা যেন সৃষ্টিকূল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে সৃষ্টিকর্তার যথাযথ পরিচয় লাভের চেষ্টা করে। তাই কোরআনে এসেছে, ‘তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। তারপর আমি তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফল-ফলাদি উৎপন্ন করি।’ (সুরা ফাতির : ২৭)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আল্লাহ তিনি, যিনি উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন (যার মধ্যে) কিছু (লতাযুক্ত, যা) মাচা আশ্রিত এবং কিছু মাচা আশ্রিত নয়। (সৃষ্টি করেছেন) খেজুর গাছ, বিভিন্ন স্বাদের খাদ্যশস্য, জয়তুন ও আনার, যা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ এবং সাদৃশ্যবিহীনও।’ (সুরা আনআম : ১৪১)।
দিনরাতের বিবর্তন : ঘোর অন্ধকার রাতের অবসানে ভোর হয়। সকালের হৃদয় জুড়ানো স্নিগ্ধ কোমল আলো-হাওয়া পুরো জগতে সৃষ্টি করে এক কর্মচাঞ্চল্য। ধীরে ধীরে সূর্য কিরণ ছড়াতে থাকে। দিনভর আলোকজ্জ্বল চারপাশ। তারপর সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে। দিনের শেষ ভাগে প্রকৃতি আবার হয়ে ওঠে নয়নাভিরাম। সন্ধ্যা নেমে আসে, আঁধার ছেয়ে যায়, আবার রাতের আগমন হয়। দিনরাতের এ অল্প সময়ে কত পরিবর্তন, কত বৈচিত্র্য! আবার বছরজুড়ে ঋতুর কত বিবর্তন! প্রকৃতিতে কী অপরূপ নৈপুণ্যের ছোঁয়া! সৃষ্টিকর্তা তাঁর কুদরতের অজস্র নিদর্শন ছড়িয়ে রেখেছেন প্রকৃতির পরতে পরতে। বান্দাকে কতভাবে তা দেখিয়েছেন, বুঝিয়েছেন। কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ আকাশ থেকে জীবিকার যে মাধ্যম অবতীর্ণ করেছেন, তারপর তা দ্বারা ভূমিকে তার মৃত্যুর পর নতুন জীবন দান করেছেন, তাতে ও বায়ু পরিবর্তনে বহু নিদর্শন আছে সেসব লোকের জন্য, যারা বোধশক্তিকে কাজে লাগায়।’ (সুরা জাসিয়া : ৫)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘নিশ্চয় আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃজনে ও রাতদিনের পালাক্রমে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯০)।
আল্লাহর আনুগত্য স্বীকারেই বুদ্ধিমত্তা : সৃষ্টিজগতের সবকিছুর মতো প্রাণীরাও আল্লাহর অনুগত। তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে আল্লাহর আনুগত্য করে এবং তাঁর ইবাদতে রত থাকে। কোরআনে এসেছে, ‘তুমি কি দেখ না, আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীতে যারা আছে, তারা ও উড্ডীয়মান পাখিরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই জানে তাঁর ইবাদতের ও পবিত্র ঘোষণার পদ্ধতি। তারা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে অবগত।’ (সুরা নুর : ৪১)। আল্লাহ সুবিশাল প্রাণিজগৎ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তারা কি উটকে দেখে না, কীভাবে তাকে ?সৃষ্টি করা হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়া : ১৭)। সুতরাং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হলো, সৃষ্টির বিচিত্র-বিস্ময় দেখে স্রষ্টার যথাযথ পরিচয় লাভের চেষ্টা করা, ঈমানকে মজবুত করে তোলা, সৃষ্টিকর্তার নেয়ামতরাজি দেখে তাঁর ক্ষমতা ও মহত্বের আশ্রয় গ্রহণ করা; সর্বোপরি কৃতজ্ঞ মনে তাঁর সব বিধিবিধান পরিপূর্ণরূপে পালনে যত্নবান হওয়া।
লেখক : প্রকৃতি বিষয়ক গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী