প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ আগস্ট, ২০২৫
ইট-কংক্রিটের রাজধানীতে চোখ খুললেই সবুজের দেখা মেলে না। সড়কদ্বীপ যেন মরুভূমি। গায়ে গা লাগিয়ে উঠছে নতুন নতুন ভবন। দুয়েকটা গাছ যা ছিল, উপড়ে ফেলা হচ্ছে। নগরায়ন-শহরায়নের ফলে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানী থেকে। প্রিয় শহরটি দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। শব্দদূষণ, ধুলাবালিতে যেন একাকার। এর ভেতর একটা গাছও যদি নজরে পড়ে, মনটা কেমন সতেজ হয়ে ওঠে। আহা সবুজ, আমার প্রাণের নির্মল পরিবেশ!
গাছ আল্লাহকে সেজদা করে। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে। গাছপালা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বহু আলোচনা এসেছে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি, তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি; তাতে নয়নাভিরাম সব ধরনের উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি। এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি। যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়।’ (সুরা কফ : ৭-৯)।
রাসুল (সা.) ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করার নির্দেশ দিতেন তিনি। তাই ইসলামে গাছ লাগানোর গুরুত্ব অপরিসীম। আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো মুসলমান কোনো গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে, আর তা থেকে কোনো পোকামাকড় কিংবা মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বোখারি : ২৩২০)।
যখন গ্রামে ছিলাম, তখনও বৃক্ষরোপণ ছিল আমার শখ। বাড়ির আশপাশে ফুল-ফলের গাছ লাগানো ছিল আমার কাজ। চার বছর হয় ঢাকা শহরে পা রেখেছি। আমাদের ছোট্ট একটি ভাড়া বাসা। বেলকুনি বলতে একটাই। তাও এক চিলতে। দুজন পাশাপাশি দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই। তারপরও সেখানে এক ডজন গাছ লাগিয়েছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে বেলকুনির দরোজা খুলে চোখের সামনে অবারিত সবুজের ছোঁয়া পাই। পাখির কিচিরমিচির সুর বেজে ওঠে। পোকামাকড় আসে ফুলের মধু খেতে।
আমার এ বেলকুনি বাগান একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় হয়েছে প্রচুর। দু’বার বাসা পাল্টিয়ে যখন বর্তমান বাসায় থিতু হলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম- বেলকুনিতে বাগান করব। আমার স্বামী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ একজন লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী। তিনিও গাছপালা খুব পছন্দ করেন। তার সহযোগিতায় প্রথমে তিন-চারটি গাছ কিনলাম। এর মধ্যে চায়না টগর একটি, গোলাপ গাছ দুটি ও বেলি গাছ একটি। কয়েকদিন পরই গোলাপ গাছদুটি মারা গেল। শূন্যস্থান পূরণ করতে আবার গাছ কিনলাম। গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েও নিয়ে এলাম কিছু বাহারি লতা ও কাঁটামুকুট।
কাছের একটি নার্সারি থেকে মাটি ও টব কিনে আনলাম। আমাদের বাড়িওয়ালাও তিনটি টব দিলেন। বাগানে গাছের সংখ্যা বাড়তে থাকল। এর মধ্যেই হঠাৎ করে বাসা পাল্টাতে হলো। আমাদের ভাড়া বাড়িটি ডেভেলপাররা গ্রাস করে নিল। বাধ্য হয়ে অন্য বাসা খুঁজতে হলো। খুঁজতে খুঁজতে এমন একটি বাসা বাজেটের মধ্যে পেলাম, যার বেলকুনি একটা। তাও একেবারেই ছোট। কী আর করা! সব মিলিয়ে ম্যানেজ করতে হলো।
সেই ছোট্ট বেলকুনিতে রোপণ করলাম এক ডজন চারা। এর মধ্যে অফিসের ফ্যামিলি ডের র্যাফেল ড্রতে ব্র্যাক নার্সারির সৌজন্যে দুই হাজার টাকার গাছ পেলেন মাহমুদ। ফোনে গাছ পাওয়ার খবর শুনে আনন্দে উদ্বেলিত হলাম। যেদিন বাসায় গাছ এলো, তখন গ্রামের বাড়ি আমি। গাছগুলো কবে নিজের চোখে দেখব, সে অপেক্ষায় প্রহর যেন কাটছিল না। তখন আমার প্রিয় কাঠগোলাপ, গন্ধরাজ, তিনটি গোলাপ, রঙ্গন, অপরাজিতাসহ মোট নয়টি গাছ পেলাম।
মাঝে মাঝে কোথাও গাছের চারা পড়ে থাকতে দেখলে কুড়িয়ে নিয়ে আসেন মাহমুদ। এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে বাসার সামনের গলিতে একটি নয়নতারা পড়ে থাকতে দেখেন। হয়তো বিকেলে কারও বেলকনি পরিষ্কার করে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তিনি গাছটি হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। কাপড় বদলে গাছটি পুতে দিলেন টবে। এখন সেই গাছটি বারো মাস ফুল দিচ্ছে। দেখলেই আনন্দে কেমন মনটা ভরে যায়।
কোথাও বেড়াতে গেলে পথের পাশে বা জলাশয়ে গাছ বা লতা দেখলে নিয়ে আসি আমরা। দক্ষিণখানে বোনের বাসা থেকে ফেরার পথে জলাশয়ে দেখলাম, অসংখ্য কয়েন প্ল্যান্ট। হাতের নাগালে যতটুকু পেয়েছি, ভ্যানেটি ব্যাগে ভরে নিয়ে এলাম। মাটির একটি চতুর্ভুজ আকৃতির টবে কয়েন প্ল্যান্ট লাগিয়ে দিলাম। কয়েক দিনের ব্যবধানে টবটি কানায় কানায় পূর্ণ হলো। নার্সারিতে যা কিনতে গেলে কমপক্ষে হাজার-বারোশ’ লাগত। এভাবে পুত্তলিকা, কাঁটামেহেদিসহ নাম না জানা কিছু ফুল এনেছি বিভিন্ন জায়গা থেকে।
গত তিন বছরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি আমার ছোট্ট বেলকুনি বাগান। ফুলের গাছের পাশাপাশি পাট গাছ লাগিয়ে শাক খেয়েছি কয়েকদিন। একবার পুঁই গাছ কিনে এনেছিলেন মাহমুদ। শাক খাওয়ার পর গাছের কাণ্ড লাগিয়েছিলাম। সেখান থেকেও দু’বার পুঁইশাক খেয়েছি। পরে ফল এসে যাওয়ায় উপড়ে ফেলেছি। এভাবে সিজনাল ধনেপাতা বুনেছি দধির পাত্রে। খেয়েছি কয়েকবার। বোম্বে মরিচের চারা করেছিলাম। কিন্তু ফুল দিয়েও ফল দেয়নি গাছদুটি। কষ্ট পেলেও গাছদুটি উপড়ে ফেলেছিলাম। এমনই স্থায়ী-অস্থায়ী অনেক গাছের হিসেব হয়তো কষা যাবে না। এখন আমার বেলকুনিতে পা রাখার জায়গা নেই। এর মধ্যে গন্ধরাজ ও একটি গোলাপ গাছ মরে যাওয়ায় দুটি টব সরিয়ে রেখেছি। কোনো একদিন নতুন গাছ এনে বসিয়ে দেব তাতে।