ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সবুজায়ন ও জীবন

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
সবুজায়ন ও জীবন

বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু। বিপুল মানুষের পদভারে কম্পিত ও সুজলা সুফলা পৃথিবী প্রতিদিন বৃক্ষশূন্য হচ্ছে। অবাধ ও নির্বিচারে চলছে বৃক্ষ নিধন। ফলে প্রাণীর জীবন ধারণের জন্য নিয়ামক অক্সিজেন প্রবলভাবে সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে। জীবিকার জন্য বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সবুজ বৃক্ষ শুধু পরিবেশকে রক্ষা করে না, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে বৃক্ষ ও বনভূমির পরিমাণ নিতান্তই অপ্রতুল। যার জন্য সারা বিশ্বেই পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। গ্রিন হাউজে আঘাত হানছে। পরিবেশ রক্ষা করা না হলে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্পের মতো মহাদুর্যোগে পড়তে হবে। সারা বিশ্বে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সম্মেলনে পরিবেশের ভারসাম্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে।

ইসলামের সোনালি যুগে সবুজায়ন : দেশজুড়ে ছোট-বড়-মাঝারি মানের ব্যাপক শিল্পায়ন, প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ, যাতায়াত ব্যবস্থার প্রসারসহ জীবনের নানা প্রয়োজনে যন্ত্রের বর্ধিত ব্যবহার অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এর ফলে প্রকৃতির ওপর বিরূপ চাপ বেড়েছে। এমনকি অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে চাষের জমিও রক্ষা পাচ্ছে না। কলকারখানার ধোঁয়া, দূষিত তরল, বর্জ্য, ক্ষতিকর গ্যাস উদ্গিরণ- এ সবই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। বিপুল পরিমাণে বিষাক্ত তরল পদার্থ নিঃসরণের ফলে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এমনকি মাটি হয়ে উঠেছে বৃক্ষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তা ছাড়া নিঃসরিত গ্যাস ও ধোঁয়া থেকে তাপ তৈরি হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর গ্যাসের ঘনত্ব বাড়ছে। এসব উপাদান প্রকৃতি, মানুষ ও প্রাণিকুলের জন্য ক্ষতিকর। এসব থেকে উত্তরণে সবুজায়ন ও কৃষি উন্নয়নের বিকল্প নেই। ইসলামের সোনালি যুগে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন সবুজায়ন ও কৃষি উন্নয়নের প্রতি খুব মনোযোগী ছিলেন। ওসমান (রা.)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি বৃদ্ধ বয়সে বৃক্ষরোপণ করছেন কেন?’

তিনি জবাব দেন, ‘সৎকর্মরত অবস্থায় আমার মৃত্যু হওয়া ফাসাদরত অবস্থা থেকে উত্তম।’ একবার আবু দারদা (রা.) আখরোট গাছ রোপণ করছিলেন। তখন তাকে বলা হয়, ‘আপনি বৃদ্ধ বয়সে এটা কেন লাগাচ্ছেন? অথচ এর ফল পেতে ২০ বছর (অর্থাৎ অনেক) সময় লাগবে।’ তিনি জবাব দেন, ‘আজর তথা প্রতিদান ছাড়া আমার অন্য কোনো চাহিদা নেই।’ (নুজহাতুল আনাম : ১৮৫)। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) ধনী হওয়া সত্ত্বেও মাঠে কোদাল নিয়ে নিজ হাতে পানি সেচনের ব্যবস্থা করতেন। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) সর্বপ্রথম মদিনার জমিতে গম চাষ করেন। এত বিশাল এলাকাজুড়ে চাষাবাদ করেন যে, উৎপন্ন শস্য মদিনাবাসীর এক বছরের খোরাকি হয়ে যেত। ফলে সিরিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানি নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়ে। (তারিখে দিমাশক : ২৫/১০২)।

মানবজীবনে সবুজায়নের গুরুত্ব : জলবায়ুর পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের জীবন-জীবিকা আজ চরম হুমকির মুখে। ইসলাম পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সবুজায়নকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। জীবনোপকরণের উপাদান হিসেবে সবুজ-শ্যামল গাছগাছালি ও নানা রকম ফলদ বৃক্ষের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে এ অমূল্য নেয়ামত দান করে থাকেন। কোরআনে এগুলো আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি ও সমুন্নত খেজুরগাছ উদ্গত করি, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। এগুলো আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ।’ (সুরা কফ : ৯-১১)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘তারা কি লক্ষ্য করে না, আমি ঊষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদ্গত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদিপশু এবং তারা নিজেরা আহার করে।’ (সুরা সাজদা : ২৭)।

সবুজের শত্রুতা মানবজাতির ধ্বংস : মানুষের বাঁচার জন্য খাদ্যের পরেই অক্সিজেন ও নির্মল বায়ু প্রয়োজন। এ অক্সিজেনের ৭০ ভাগ জোগান আসে গাছপালা থেকে। কিন্তু গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে বাড়ছে বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা। গবেষকদের মতে- ধোঁয়া, ধুলা, কাঠের গুঁড়া, ছাই, তুষ, সূক্ষ্ম বস্তুকণা বায়ুদূষণের জন্য ৫০ ভাগ দায়ী। ওই সকল বস্তুকণা ও ধুলা গাছের পাতার রং বিবর্ণ করে দিচ্ছে। পাতার ওপর ধুলার আস্তর জমার ফলে সূর্যের আলো থেকে গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে অক্সিজেন গ্রহণ করে, তাতে বিঘ্ন ঘটছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে মানুষ প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করে দাসে পরিণত করছে। একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ ভুলে গেছে, প্রকৃতি মানুষের দাস নয়, মানুষই প্রকৃতির দাস। মানুষ না থাকলেও প্রকৃতি থাকবে; কিন্তু প্রকৃতির সুন্দর পরিবেশ না হলে মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর। অথচ উন্নয়নের নামে দেশব্যাপী গাছ কাটার মহোৎসব চলছে। গাছপালা বাঁচিয়ে উন্নয়ন অসম্ভব নয়। যারা সবুজ বন, ক্ষেত-খামার ও বাগান ধ্বংস করে, তারা ইসলামের দৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। আল্লাহ বলেন, ‘যখন সে প্রস্থান করে, তখন পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না।’ (সুরা বাকারা : ২০৫)।

উদ্ভিদের গবেষণায় উৎসাহ ও প্রেরণা : বৃক্ষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে ও পরিবেশ বাঁচায়। মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার বার প্রশ্বাসের ফলে ১৬ কিলোগ্রাম অক্সিজেন গ্রহণ করে। সবুজ উদ্ভিদ সূর্যালোকের সংস্পর্শে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে অক্সিজেনে রূপান্তর করে এবং বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। মানুষ ও প্রাণীর খাদ্যের উল্লেখযোগ্য উৎস বৃক্ষ। তা ছাড়া ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রার ভারসাম্য, বায়ুমণ্ডলের বিশুদ্ধতা, পাখির নিরাপদ আবাসস্থল, মাটির ক্ষয় রোধ, ঝড়ের সময় ধ্বংসাত্মক বাতাসের গতিকে প্রশমিত করা- এসবেরও সহায়ক। প্রয়োজনের তুলনায় গাছ যত কমবে, এমন সুবিধাও তত কমে আসবে। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়তে থাকবে এবং বিপর্যয়কালীন ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পাবে। ইসলাম সবুজায়ন ও প্রকৃতির সুরক্ষায় ফল, ফসল ও উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে; যেন মুসলমানরা একটি সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক। আমিই প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করি। পরে আমি ভূমি উত্তমরূপে বিদারিত করি। আমি তাতে উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগান, ফল ও গবাদি খাদ্য। এটা তোমাদের ও তোমাদের জীবজন্তুর ভোগের জন্য।’ (সুরা আবাসা : ২৪-৩২)।

সবুজায়নে উপকার ও মহাপুরস্কার : সভ্যতার অহংকার আধিপত্য ও আগ্রাসী নীতি পৃথিবীকে তিলে তিলে গ্রাস করছে। প্রকৃতির ওপর মানুষের খবরদারি যতই বাড়ছে, প্রকৃতি ততই বৈরী হয়ে মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। মানুষ যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠছে, বসবাস করছে, তাকেই নানাভাবে দূষিত করে তুলছে। বিনা প্রয়োজনে যখন-তখন কাটা হচ্ছে গাছপালা, দখল-দূষণে ভরিয়ে তুলছে নদী-নালা। প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তুলছে হাউজিং প্রকল্প, পিকনিক স্পট ও বিনোদনকেন্দ্র। আবাদি জমি নষ্ট করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তৈরি করছে শিল্পকারখানা।

এতে একদিকে যেমন ফসলি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। তাই ইসলাম বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদের মাধ্যমে মানুষকে সবুজায়ন করতে উৎসাহিত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা (দান)-স্বরূপ গণ্য হবে।’ (বোখারি : ২৩২০)। তিনি আরও বলেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জান যে, কেয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ : ৪৭৯)।

বৃক্ষনিধনের কুফল ও শাস্তি : ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট পার্ক, রাস্তার বিভাজক, লেকের পাড়, নদীর তীর আছে। এসব জায়গায় পরিবেশ বুঝে বৃক্ষ নির্বাচন করা প্রয়োজন। যদিও এখানে দেশি ও পরিবেশ-উপযোগী বৃক্ষের চেয়ে বিদেশি এবং বাংলাদেশের মাটি ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন গাছই বেশি চোখে পড়ে। এসব বৃক্ষের বেশির ভাগেই পাখি বাস করতে পারে না। তা ছাড়া এমন ধরনের কীটপতঙ্গ জন্মায়, যেগুলো বাংলাদেশের প্রকৃতির পক্ষে সহায়ক নয়। এসব বৃক্ষের যেগুলোতে ফুল ও ফল হয়, সেসব পাখি খায় না। এসব গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে। ফলে ওই অঞ্চলের মাটিতে লতাগুল্ম, ঝোপজাতীয় ছোট ছোট উদ্ভিদ সাধারণত জন্মে না। কাজেই কেবল পাখিই নয়, এসব লতাগুল্ম ও ঝোপঝাড়ে অন্যান্য পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ব্যাঙ, প্রজাপতি ইত্যাদি ছোট ছোট প্রাণী বাস করতে পারে না। কেননা, এসব প্রাণী একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। পাখি ফল ও কীটপতঙ্গ খায়। পতঙ্গ, প্রজাপতি পরাগায়ন ঘটায়; ফুল ফোটে, ফুলের গন্ধে ও মধুর লোভে মৌমাছি আসে। এভাবে চলে একটা প্রাকৃতিক জীবনচক্র। যেটি প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের কারণে বিপর্যস্ত।

ইসলাম যুদ্ধের মতো চরম প্রতিকূল অবস্থায়ও বৃক্ষনিধন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কোনো বাহিনী প্রেরণের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) ফলদ, ছায়াদার ও উপকারী বৃক্ষনিধন, ফসলের মাঠ ধ্বংস ও গবাদিপশু হত্যা করতে নিষেধ করতেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বরইগাছ কাটবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-কে এ হাদিসের অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এ হাদিসের বক্তব্যটি সংক্ষিপ্ত, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- যে ব্যক্তি অকারণে বা অন্যায়ভাবে মরুভূমির কোনো বরইগাছ কাটবে, যেখানে পথিক বা কোনো প্রাণী ছায়া গ্রহণ করে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫২৩৯)।

লেখক : প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষক এবং গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত