
দেশের পোশাক শিল্প বর্তমানে নানা সংকটে জর্জরিত। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি এবং ক্রয়াদেশে মন্দাভাবের কারণে এই খাতে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উৎপাদনশীল কারখানা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে একধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা জটিলতায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা। ফলে কর্মসংস্থানে নেমে এসেছে খরা। অন্যদিকে নতুন উদ্যোক্তাও কম। আর্থিক সংকটের কারণে অনেক ব্যাংকই ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলভিত্তিই হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসে এই খাত থেকে, যা প্রতি বছর গড়ে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক- যার বেশির ভাগই নারী এই খাতে কর্মরত। ফলে এই সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও ফেলছে।
ইউরোপ ও আমেরিকার মতো প্রধান ক্রেতা দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানির পরিমাণ কমেছে। অনেক কারখানায় অর্ডার আগের তুলনায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অথচ পণ্যের মূল্য সেই অনুপাতে বাড়েনি।
পাশাপাশি ডলার সংকট ও এলসি খুলতে জটিলতা তৈরি হওয়ায় অনেক উদ্যোক্তা কাঁচামাল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অনিয়মিত সরবরাহও উৎপাদনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কারখানাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পেয়ে বাধ্য হচ্ছে উৎপাদন আংশিক বন্ধ রাখতে বা বিকল্পভাবে ব্যয়বহুল ডিজেলচালিত জেনারেটরের ওপর নির্ভর করতে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, এই অস্থিরতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে বিদেশি ক্রেতারা অন্য দেশমুখী হতে পারে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
বর্তমানে পোশাক খাতের সংকট একাধিক দিক থেকে ঘিরে ধরেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ডলার নিয়ে জটিলতা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, এলসি (ঋণপত্র) জটিলতা, অর্ডার সংকোচন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস ঘাটতি, শ্রমিক অসন্তোষ এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়- সব মিলিয়ে এ খাতে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এই খাতে চলমান সংকট অব্যাহত থাকলে শুধু রপ্তানি আয় নয়, সামাজিক নিরাপত্তা, নারী কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হুমকির মুখে পড়বে। সরকারের উচিত হবে- সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে জরুরিভিত্তিতে একটি সংকট ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।