ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ব্যবসা সহজীকরণে সংস্কার চলমান

ব্যবসা সহজীকরণে সংস্কার চলমান

গত বছর ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মধ্যে দেশের দ্রব্যমূল্যের বাজারে একটি উল্লেখযোগ্য রূপান্তর দেখা গেছে। বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল এবং ব্যবসা পরিচালনার সহজতর পরিবেশ তৈরি করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে গত এক বছরে, বিশেষত মুসলিম উম্মাহর দুটি বৃহত্তম উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পবিত্র ঈদুল আজহার সময় বাজারে নজরকাড়া স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কঠোর মনিটরিং, পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং চাঁদাবাজি রোধে কার্যকর উদ্যোগের ফলে এই সাফল্য এসেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিক সাফল্য, কার্যক্রম ও সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে নিজ দপ্তরে জাতীয় বার্তা সংস্থা সঙ্গে আলাপকালে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখন বাজার পরিস্থিতি অনেক ভালো। গত ১২ মাস ধরে বাজার স্থিতিশীল এবং এখন আর তেমন কোনো উদ্বেগ নেই।

তিনি বলেন, এই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে সরকার বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করবে এবং পাশাপাশি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করা হবে। যদি তা হয়, আমি আশা করি, বাজারে আরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাণিজ্য সচিব বলেন, বাজার পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয় প্রায়ই লক্ষ্য করে, পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেলে বাজারে কখনও কখনও অস্থিরতা তৈরি হয়। সাধারণত পবিত্র রমজান মাস ও অন্যান্য উৎসবকেন্দ্রিক সময়ে এই চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তিনি জানান, এ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম আরও জোরদার করেছে। গত বছর যেখানে ১২টি দল কাজ করছিল, সেখানে এ বছর ২৮টি দল মাঠে টানা কাজ করেছে। এবার বিভাগীয় পর্যায়ের গণ্ডি পেরিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও বাজার মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, চাহিদার তুলনায় যদি পর্যাপ্ত পণ্যের জোগান নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আলহামদুলিল্লাহ, এ বছর পবিত্র রমজান ও ঈদুল আজহার সময় সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো ছিল এবং কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে আমরা বাজার স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছি। বাণিজ্য সচিব জানান, পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এ বছর ৪০০ বেশি দল সার্বক্ষণিক মাঠে ছিল। এই পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয় উপস্থিতি মূলত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, জুন মাসের শেষ ভাগ থেকে জুলাইয়ের শুরুর দিক পর্যন্ত বাজারে কিছুটা চালের ঘাটতি দেখা দিলেও বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমি মনে করি, এখন এ নিয়ে তেমন কোনো উদ্বেগের কারণ নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, টিসিবির কাভারেজ ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং বর্তমানে প্রায় এক কোটি পারিবারিক কার্ডধারী এই সুবিধার আওতায় আসছেন। এই কাঠামোগত কাভারেজের ফলে নির্ধারিত উপকারভোগীরা সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন। টিসিবির স্মার্ট কার্ড নিয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, এক কোটি উপকারভোগী পরিবারের সবারই স্মার্টফোন নেই। ফলে টিসিবির পণ্য ভর্তুকিমূল্যে নিতে স্মার্ট কার্ড ব্যবহারে অনেকেই সমস্যায় পড়েন। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন তাদের সহায়তা করছে। তিনি জানান, টিসিবির নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ‘ট্রাক সেল’ কার্যক্রমও চালু থাকবে। গত এক বছরে বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে কী ধরনের সংস্কার হয়েছে —জানতে চাইলে সচিব বলেন, মূল সংস্কার হচ্ছে ‘ইজি অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ব্যবসা করার সহজতর পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে আমদানি নীতিতে কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে, যাতে সনদ ও অনুমোদন প্রদান প্রক্রিয়া সহজ হয়। তিনি জানান, একটি বড় সংস্কার উদ্যোগ হচ্ছে বাণিজ্য সংক্রান্ত আদালত প্রতিষ্ঠা করা, যা নিয়ে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে।

সচিব বলেন, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত এরইমধ্যে নেওয়া হয়েছে এবং এখন আমরা বাস্তবায়ন পর্বে যাবো। এ লক্ষ্যে একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে এবং আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। এই আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবসায়ীরা তাদের বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে সরাসরি আদালতে যেতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে এসব আদালত স্থাপন করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট জেলা ও দায়রা জজরা এসব আদালত পরিচালনা করবেন। পরে প্রয়োজনে এ কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির অগ্রগতি নিয়ে সচিব বলেন, এরইমধ্যে ভুটানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ কিছু বহুপাক্ষিক চুক্তিরও অংশ। এছাড়া জাপানের সঙ্গে ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (ইপিএ) নিয়ে সপ্তম দফার আলোচনা আগস্টেই শুরু হবে। একইভাবে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গেও চুক্তির জন্য আলোচনা পুনরায় শুরু হবে। বাণিজ্য সচিব বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সঙ্গে চুক্তির লক্ষ্যে টার্মস অব রেফারেন্স চূড়ান্ত করা হবে, সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও আলোচনা এগোচ্ছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নাইজেরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়েও কাজ চলছে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও দেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে এবং রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণে অগ্রগতি হচ্ছে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক বিষয়ে আলোচনা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। খুচরা ও পাইকারি দামের পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, এ নিয়ে এরইমধ্যে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সরকারের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে এই খাতে ‘অননুমোদিত ব্যয়’ বা যাকে সাধারণভাবে চাঁদাবাজি বলা হয়, তা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর কয়েক মাস পণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করেছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়ে ওঠেছে। তবে তিনি বলেন, সব কিছুর পরেও ডিম, ভোজ্যতেল ও মুরগির মতো কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও দামে এখনও সমস্যা রয়েছে। চরম গরমসহ নানা কারণে এসব পণ্যের সরবরাহ ও দামে ওঠানামা দেখা যায়। গত এক বছরে পণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতার যে ধারা তৈরি হয়েছে, তা সাধারণ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের সাধারণ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১১.৬৬ শতাংশ, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরমধ্যে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪.১০ শতাংশ, যা অন্তত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অখাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও বেড়ে দাঁড়ায় ৯.৬৮ শতাংশে। তবে ২০২৫ সালের জুনে খাদ্যসামগ্রীর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ৭.৩৯ শতাংশ, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৫ সালের মে মাসে এটি ছিল ৮.৫৯ শতাংশ। একই সময়ে অখাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমে জুনে দাঁড়ায় ৯.৩৭ শতাংশ, মে মাসে তা ছিল ৯.৪২ শতাংশ। শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাতেই মূল্যস্ফীতির হার গত মাসে কমেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত