রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা, তায়েফ ও হুনাইন বিজয় শেষে মদিনায় ফিরছিলেন। তখনও মক্কা নগরীর সীমানা অতিক্রম করেননি। এর মধ্যে জোহর নামাজের সময় হয়। নবীজিসহ সাহাবিরা এক উপত্যকায় যাত্রা বিরতি করলেন। দুপুরের রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। চারদিকে সবুজের বিস্তীর্ণ বনভূমি। সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়ানো মরুর বালু-মাটি। উপত্যকাজুড়ে গৃহপালিত পশুর অবাধ বিচরণ। দুম্বা, ভেড়া, উটের পাল নিয়ন্ত্রণে সেখানে কাজ করছে রাখালের দল। রাখালেরা বয়সে কিশোর-তরুণ। তারা তখন গাছের ছায়ামায়ায় আড্ডা দিচ্ছে।
নবীজি (সা.) বেলাল (রা.)-কে আজান দিতে বললেন। বেলাল (রা.) কিবলামুখী দাঁড়িয়ে কণ্ঠে মনের মাধুরী মিশিয়ে উচ্চারণ করলেন ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার...’। বেলালের আজানের ধ্বনি উপত্যকায় বকরি চড়ানো কিশোর রাখালদের কানে পৌঁছায়। এক কিশোর ব্যঙ্গ করে আজানের শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। কিশোর তখনও জানে না এই শব্দগুলো কী বার্তা নিয়ে বাতাসের শরীরে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই শব্দগুলোর অর্থই-বা কী।
এই শব্দগুলোর উচ্চারণই কিশোরকে অন্ধকার জীবনের গলিপথ থেকে বের করে পবিত্র আলোর সন্ধান দিয়েছে। জীবনকে করেছে মহিমান্বিত। প্রিয় করেছে সবার প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর। বানিয়েছে আল্লাহর ঘরের আনুষ্ঠানিক প্রথম মুয়াজ্জিন। ঠাট্টায় দেওয়া আজানের কণ্ঠই পরে কাবা চত্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেয় মহামহিমের বড়ত্বের। ঘোষণা দেয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর রিসালাতের। তার সুললিত কণ্ঠের পথ ধরে মানুষ আল্লাহর মিছিলে শরিক হন। আল্লাহর ঘরে হাজীরা যান। চুমো দেন আল্লাহর কুদরতি পায়ে।
কিশোরের ব্যঙ্গাত্মক আজানের স্বর নবীজি (সা.)-এর কানে পৌঁছায়। নবীজি (সা.) আলি ও জুবাইর (রা.)-এর মাধ্যমে তাকে ডেকে পাঠান। সেখানে ছিল রাখাল কিশোরদের একটি দল। ভয়ে কেউ স্বীকার করছিল না। তারা কিশোরদের নিয়ে আসেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কে এইমাত্র আজান দিয়েছ? তারা পরস্পর চাওয়া-চাওয়ি করছে। ভয় ও লজ্জায় কেউ কিছু বলছে না। কারণ, তারা আজান দিয়েছিল ঠাট্টাচ্ছলে। ব্যঙ্গ করে। নবীজি (সা.) তখন প্রত্যেকের আজান শুনতে লাগলেন। সর্বশেষ আসে সেই বালকের পালা। যে ঠাট্টা করে আজান দিয়েছিল। নবীজি তার গলার আওয়াজ চিনলেন। ভারি মিষ্টি গলার আওয়াজ। নবীজির মনে ধরল। বললেন, তুমিই এই মাত্রই আজান দিয়েছ। কিশোর বললেন, সম্মতির মাথা নাড়লেন।
কিশোরের নাম আবু মাহজুরা। ১৬ বছর বয়স। কেউ বলেন, সালমান, সামুরা ও সালামা তার নাম। মক্কার অধিবাসী। কুরাইশের জুমা গোত্রের। পেশায় রাখাল। ধারণা করা হয় পিতার নাম উমায়ের। নবীজি (সা.) তাঁর বরকতময় হাত আবু মাহজুরার মাথায় রাখলেন। চুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে কোমল স্পর্শ দিতে লাগলেন। পুরো শরীরে অপূর্ব শান্তি ছুঁয়ে যাচ্ছে আবু মাহজুরার। সেসময় নবীজি তার জন্য দোয়া করলেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক ফিহি, ওয়াহ দিহি ইলাল ইসলাম।’ (হে আল্লাহ, তুমি তাকে বরকত দাও এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দাও।’
যে জীবন নবীজি (সা.)-এর দোয়া পেয়েছে, নবীজির সংশ্রব পেয়েছে, ভালোবাসার স্পর্শ লাভ করেছে; তার চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কে আছে? পৃথিবীর কোনো সোহাগ আর প্রেম দিয়ে এই প্রেম-সোহাগ পরিমাপ করা যাবে? কোনো ভাষা দিয়ে লেখা যাবে এই প্রেমের কাব্য?
আবু মাহজুরার ভাগ্য খুলে গেল। অন্তর প্রশস্ত হলো সত্য ধর্মের জন্য। উচ্চারণ করলেন, ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আন্নাকা রাসুলুল্লাহ।’ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া সত্য উপাসক নেই। নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল।) আবু মাহজুরার ইসলাম গ্রহণে নবীজি (সা.) খুশি হলেন। তাকে উপহার দিলেন মসজিদে হারামের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব। এখন থেকে গোঁফ না ওঠা রাখাল বালক আবু মাহজুরার কণ্ঠে উচ্চারিত হবে পবিত্র আজানের ধ্বনি। কাবা চত্বরে দাঁড়িয়ে আবু মাহজুরা পাঁচ সময়ে মুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেবেন মহামহিমের বড়ত্ব ও নবীজির রিসালতের কথা। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ঘর- কাবার মুয়াজ্জিন আবু মাহজুরা। আহ্, কতই না খুশ নসিব আপনার হে আবু মাহজুরা।
এই ঠাট্টা-বিদ্রূপের আজান, বাতাসে ভর করে নবীজির কানে পৌঁছা, নবীজির কাছে ডাকা, তাঁর পবিত্র হাতের স্পর্শ, এরকমভাবে মায়া-দরদের দোয়া- আবু মাহজুরার জীবনের জন্য কতই না সৌভাগ্য। কতই না সুন্দর চমৎকার ইতিহাসের সাক্ষী সেদিনের দিনটি, সেদিনের দুপুর, সেই বাতাস, সেই উপত্যকা।
আবু মাহজুরা সৌভাগ্যের চাদর জড়িয়ে, নবীজি (সা.)-এর তরফ থেকে পাওয়া মুয়াজ্জিনের সেরা দায়িত্ব নিয়ে প্রতিদিন কাবা চত্বরে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা ঢেলে আজান দেন। মানুষকে নামাজের দিকে ডাকেন। এভাবে আমৃত্যু তিনি আজান দিয়ে যান। আর মনে পড়ে সেই রোদের দুপুর, সেই উপত্যকা, সেই ঠাট্টাচ্ছলে আজান, রাসুলের পবিত্র হাতের ছোঁয়া।
নবীজি (সা.)-এর হাতের স্পর্শের প্রেমে মজে রইলেন আবু মাহজুরা। এই স্পর্শের কথা তিনি ভুলতে পারেন না। দিন-রাত শুধু মনে পড়ে। মনে পড়ে যায়। তার জীবনের সবচেয়ে বড় পুঁজি এই ছোঁয়া। এই ছোঁয়াই তো তাকে মানুষ করেছে। বানিয়েছে কাবার মুয়াজ্জিন।
এদিকে আবু মাহজুরার মাথার চুল বাড়ছে। বড় হচ্ছে। স্ত্রী ও পরিবারের লোকেরা চুল কাটতে তাগিদ করেন। পরিচিতরাও বলেন চুল কাটার কথা। আবু মাহজুরা চুল কাটেন না। বলেন, এই চুল আমি কাটতে পারি না। এই চুলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতের পরম স্পর্শ রয়েছে। এই চুল ধরে তিনি আমার জন্য দোয়া করেছেন। আমাকে আদর করেছেন। এই চুল আমি কাটতে পারব না। তার স্পর্শের চুল আমি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি না।
আবু মাহজুরা বেঁচে থাকার জীবনে কোনো দিন চুল কাটেননি। নবীজি (সা.)-এর সেই স্পর্শের স্মৃতি ও বরকত নিয়ে বেঁচে রইলেন। মৃত্যুর পরও বোধ হয় আবু মাহজুরার সেই স্পর্শের চুলগুলো সতেজ তরুতাজা রয়ে গেছে। হাশরের মাঠে এই স্পর্শের চুলই তো আপনার জন্য যথেষ্ট হে আবু মাহজুরা।
আবু মাহজুরা ৫৯ হিজরিতে মারা যান। আজানের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওয়ারিশদের ওপর। এভাবে ৩০০ বছর পর্যন্ত তারা কাবার মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করলেন।