আমি আপনাদের আল্লাহর অশেষ দয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, সেই মহা নেয়ামতগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি, যেগুলো আল্লাহ দান করেছেন, যেগুলোর হিসাব শুধু তিনিই জানেন। এই নেয়ামতগুলোর দাবি হলো- আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব ও সবসময় তাকে স্মরণ করব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, ‘তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের অবশ্যই অধিক দেব। আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)।
আপনারা কি জানেন- আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সুসংবাদ কী? সবচেয়ে বড় সুসংবাদ আল্লাহ তাঁর অহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি অন্যসব সৃষ্টি ও তাঁর বান্দাদের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন তার ভিত্তি হলো রহমত ও দয়া। এই দয়া শুধু মুমিনদের জন্য নয়; বরং দুনিয়ার জীবনে সৎ-অসৎ, মুমিন-কাফের সবাই আল্লাহর দয়ার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী।’ (সুরা মোমিন : ৭)।
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক পরম ক্ষমাশীল, দয়াবান।’ (সুরা কাহাফ : ৫৮)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘তোমাদের প্রতিপালক দয়া করা তাঁর কর্তব্য বলে স্থির করেছেন।’ (সুরা আনআম : ৫৪)। তবে আখেরাতে আল্লাহ শুধুমাত্র মুমিনদের এই বিশেষ দয়া প্রদান করবেন- কারণ তারা তাঁর আদেশ মানে ও গুনাহ থেকে বিরত থাকে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও তোমাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করে; অন্ধকার থেকে তোমাদের আলোকে আনবার জন্য। আর তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব : ৪৩)। আল্লাহ কারও প্রতি সামান্য পরিমাণও অন্যায় করেন না।
এই রহমত বা দয়া- আল্লাহর এক বিশেষ গুণ যা শুধুমাত্র তাঁর জন্যই মানানসই। আমরা এর অর্থ বুঝতে পারি; কিন্তু এর প্রকৃতি কেমন, সেটা শুধু আল্লাহ জানেন। সাহাবায়েকেরাম ও আগের সৎ মুসলমানদের পথ অনুসরণ করাই নিরাপদ- নতুন কোনো ভুল মত চালু করা বিপজ্জনক। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর একশ ভাগ রহমত আছে। এর মধ্যে একভাগ রহমত তিনি জিন, মানুষ, চুতষ্পদ জন্তু ও কীট-পতঙ্গের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। এ এক ভাগ রহমতের কারণেই সৃষ্ট জীব পরস্পর একে অপরের প্রতি দয়া করে। এ এক ভাগ রহমতের মাধ্যমে বন্য পশু নিজ সন্তানের প্রতি দয়া ও অনুকম্পা প্রদর্শন করে। মহান আল্লাহ তাঁর ১০০ ভাগ রহমতের নিরানব্বই ভাগ রহমত নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। এর দ্বারা তিনি কেয়ামতের দিন স্বীয় বান্দাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (মুসলিম : ৬৮৬৭)। এই একটি দয়া দিয়েই দুনিয়ায় এত ভালোবাসা ও সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, আর কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার পূর্ণ ১০০ দয়া দিয়ে বান্দাদের ক্ষমা করবেন।
রহমতই জীবনের সৌন্দর্য। রহমতের কারণেই সমাজে শান্তি থাকে। রহমতের মাধ্যমেই দুর্বল, গরিব ও নির্যাতিত মানুষগুলো ধনী, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবানদের আশ্রয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকে। যখন সমাজ থেকে দয়া উঠে যায়, তখন জীবন কঠিন হয়ে পড়ে, কষ্ট বাড়ে ও মানুষের মধ্যে বিপদ বাড়তে থাকে। আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ পরম দয়ালু, মানুষের জন্য রহমত হিসেবে তিনিই কোরআন নাজিল করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এগুলো জ্ঞানগর্ভ কিতাবের আয়াত, পথনির্দেশ ও দয়াস্বরূপ সৎকর্মপরায়ণদের জন্য।’ (সুরা লোকমান : ২-৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘এটা দলিল এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত।’ (সুরা জাসিয়া : ২০)।
আল্লাহ প্রত্যেক সুরার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লিখেছেন, যেন মানুষ বুঝে নেয়, আল্লাহর প্রতিটি হুকুমে দয়া, কল্যাণ ও উঁচু মর্যাদা আছে। তাঁর নিষেধাজ্ঞাগুলোতেও দয়া আছে, যেগুলো মানুষকে বিপদ ও ধ্বংস থেকে রক্ষা করে। আল্লাহর কাহিনিগুলো শিক্ষা ও উপদেশ। মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)-কে দুনিয়ার মানুষের জন্য দয়া হিসেবে পাঠিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি শুধু রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)।
রাসুলুুল্লাহ (সা.) মুমিনদের জন্য দুনিয়াতেও রহমত এবং আখেরাতেও রহমত। এমনকি কাফেরদের জন্যও এক ধরনের রহমত- তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের অনেক শাস্তি কমিয়ে দিয়েছেন, তাদের অনেক ক্ষতির পথ রোধ করেছেন, যেগুলো পৃথিবীতে ধ্বংস সৃষ্টি করত এবং নিরপরাধদের পিষে ফেলত।
আল্লাহ মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, কেউ চাইলে আল্লাহর রহমতের পথ পেতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমার রহমত প্রত্যেক বস্তুতে পরিব্যাপ্ত। সুতরাং আমি এটা তাদের জন্যে নির্ধারিত করব যারা তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করে, জাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনে বিশ্বাস করে। যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক নিরক্ষর নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজিল, যা তাদের কাছে আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়, যে তাদের সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে বাধা দেয়, যে তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু হালাল করে ও অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর যে মুক্ত করে তাদের তাদের গুরুভার থেকে এবং শৃঙ্খল থেকে- যা তাদের ওপর ছিল।’ (সুরা আরাফ : ১৫৬-১৫৭)।
ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভ ও যেসব কাজ-কর্ম এই আদেশ-নিষেধের সঙ্গে যুক্ত- এসবই আল্লাহর রহমত অর্জনের মাধ্যম। আর কিছুদিন আগে যে হজ অনুষ্ঠিত হলো, তা ইসলামের এই স্তম্ভগুলোর পূর্ণতা, যেটি রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে সম্পাদন করেছেন, আর তখনই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে ও সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও জমিনের মতো, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকিদের জন্য, যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে আর যারা ক্রোধ সংবরণকারী ও মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৩-১৩৪)।
হে আল্লাহর বান্দারা, তোমাদের ওপর তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, ভালো কাজের, কল্যাণের ও পুণ্যের ফসল নেমে এসেছে। এর প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হবে, সেটা শুধু আসমান-জমিনের প্রভুই জানেন। আল্লাহ ছাড়া আর কে-ই বা জানে, কী পরিমাণ নেয়ামত ও রহমত আল্লাহ দিয়েছেন সেই সব লোককে যারা হজ করেছে, যারা আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়েছে, সেই পবিত্র মুহূর্তগুলোতে কান্নাকাটি করে দোয়া করেছে, আর যিনি জিলহজ মাসের ১০ দিনে একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করেছেন, তাদের প্রতি কত পুরস্কার বর্ষিত হয়েছে!
আল্লাহ ছাড়া আর কে জানে, কী অনুগ্রহ বর্ষিত হয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি মুসলমানের ওপর, যারা আরাফার দিন রোজা রেখেছে, যারা এই ১০ দিনে আল্লাহকে বেশি করে স্মরণ করেছে, নামাজ পড়েছে, দোয়া করেছে, কোরবানির পশু জবাই করেছে- আর আল্লাহ সেই কোরবানির বদৌলতে প্রতিটি মুসলমানকে অনেক বেশি সওয়াব দিয়েছেন, অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। মানুষ ততদিন ভালো থাকবে, যতদিন তারা দ্বীনের বিধান মেনে চলবে। যতদিন হজ চলতে থাকবে, ততদিন মানুষের মধ্যে কল্যাণ থাকবে।
হে সমস্ত মুসলমান ভাইয়েরা, এই দিনগুলো তোমাদের জন্য ছিল ইবাদতের পবিত্র দিন। এখন হজের মাস শেষে, তোমরা প্রত্যেকেই ফিরে এসেছ আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ ও তাঁর মার্জনার বার্তা নিয়ে। আল্লাহ যার ভাগে যা লিখে রেখেছেন, তা প্রত্যেকে পেয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারপর তারা আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল, কোনো অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি। আল্লাহ যাতে রাজি তারা তারই অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহাঅনুগ্রহশীল।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৭৪)। তাই, তোমরা যা ভালো কাজ করেছ, তা ধরে রাখো।
তোমাদের ভালো কাজগুলো যেন তোমাদের খারাপ কাজের দরুন মুছে না যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করো। আর তোমাদের কর্ম বিনষ্ট করো না।’ (সুরা মুহাম্মাদ : ৩৩)। তোমরা আল্লাহর কাছে নিজের জন্য, শাসকদের জন্য ও সব মুসলমানের জন্য কল্যাণ ও দ্বীনের ওপর অটল থাকার দোয়া করো।
(১৭-১২-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ১৩-০৬-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আবদুল কাইয়ুম শেখ)