ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভুল স্বীকার করা নৈতিক দায়িত্ব

মাওলানা মাহমুদ হাসান
ভুল স্বীকার করা নৈতিক দায়িত্ব

পৃথিবীর প্রথম মানুষ ভুল করেছিলেন, সে ধারাবাহিকতায় সব মানুষেরই ভুল হতে পারে। তবে ভুলের পর তা স্বীকার করা ও অনুতপ্ত হওয়াই মনুষ্যত্বের পরিচয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই ভুল করে। আর ভুল করার পর যারা তওবা করে তারা উত্তম।’ (ইবনে মাজাহ : ৪২৫১)। ভুল স্বীকার না করা এবং ভুলের ওপর অটল থাকা আল্লাহ পছন্দ করেন না। বরং ভুল করার পর বান্দা অনুতপ্ত হবে এটাই আল্লাহর পছন্দ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যদি তোমরা পাপ না করতে তবে আল্লাহ এমন মাখলুক বানাতেন, যারা পাপ করত এবং আল্লাহ তাদের মাফ করে দিতেন।’ (মুসলিম : ৬৮৫৬)।

ইসলামের শিক্ষা হলো ভুল স্বীকার করা মানুষের দুর্বলতা নয়। কারণ সৃষ্টিগতভাবেই ভুল করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে। তাই ভুল হলে স্বীকার করে নেওয়াই যৌক্তিক এবং উত্তম বান্দার বৈশিষ্ট্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি মানুষ ভুল করে, সর্বোত্তম ভুলকারী যে অনুতপ্ত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ (তিরমিজি : ২৪৯৯)।

ভুল স্বীকারকারীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্ষমা লাভের উপযুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং অপর কতক লোক নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে, তারা এক ভালো কাজের সঙ্গে অন্য মন্দ কাজ মিশ্রিত করেছে। আল্লাহ হয়তো তাদের ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবা : ১০২)। ভুল স্বীকারকারীর ব্যাপারে বান্দাদের প্রতিও মহান আল্লাহর নির্দেশ তা-ই। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী ও মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৪)।

ভুল স্বীকারের গুণ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একজন ব্যক্তি যখন সাহসের সঙ্গে নিজের ভুল স্বীকার করে এবং তার জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চায়, তখন তা অন্যের মনে তার প্রতি সম্মান বাড়িয়ে দেয়। একটি অকপট স্বীকারোক্তি সাময়িকভাবে কিছুটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করলেও তার ফল সুদূরপ্রসারী। ভুল স্বীকারকারী এগিয়ে যায়; যে ব্যক্তি ভুল স্বীকার করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, ক্ষমাকারী ব্যক্তির চেয়ে সে অগ্রগামী। আবু দারদা (রা.) বলেন, একবার আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর মধ্যে বিতর্ক হলো, আবু বকর (রা.) ওমর (রা.)-কে রাগিয়ে দিয়েছিলেন। ওমর (রা.) রাগান্বিত অবস্থায় সেখান থেকে চলে গেলেন। আবু বকর (রা.) তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে পিছু নিলেন। কিন্তু ওমর (রা.) ক্ষমা করলেন না, বরং তার সম্মুখের দরজা বন্ধ করে দিলেন। এরপর আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে এলেন। আবু দারদা (রা.) বলেন, আমরা তখন মহানবী (সা.)-এর কাছে ছিলাম, ঘটনা শোনার পর আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের এই সঙ্গী আবু বকর আগে কল্যাণ লাভ করেছে।’ (বোখারি : ৪৬৪০)।

ভুল স্বীকার করা নৈতিক শক্তির প্রমাণ। ভুল স্বীকার করা মানুষের দুর্বলতা নয়, বরং তা নৈতিক শক্তিরই প্রমাণ। ইসলামের দৃষ্টিতে ভুলের ওপর অটল থাকা নিন্দনীয়। আল্লাহ ভুল স্বীকারকারীকে ক্ষমা করেন। ভুল স্বীকার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উপকার হলো, এর মাধ্যমে রাব্বুল আলামিনের ক্ষমা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহর আদেশ অমান্য করে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেলেছিলেন। তারা অনুতপ্ত হন, আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারা বলেছিলেন, ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন, তা হলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’ (সুরা আরাফ : ২৩)। তাদের এ আকুতিভরা প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন এবং তাদের ক্ষমা করে দেন। পক্ষান্তরে ইবলিস অহংকারবশত নিজের ভুল স্বীকার করেনি, বরং সে আল্লাহর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়। ফলে সে চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হয়। সুতরাং বোঝা যায়, ভুল স্বীকার করা নবীদের গুণ আর নিজ ভুলে অটল থাকা শয়তানের বৈশিষ্ট্য।

আল্লাহর নবী ইউনুস (আ.) তাঁর সম্প্রদায়ের ওপর হতাশ হয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা না করেই কর্মস্থল ত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে যখন তিনি মাছের পেটে বন্দি হন, তখন তিনি অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। তিনি এই বলে দোয়া করেন, ‘(হে আল্লাহ!) তুমি ছাড়া কোনো উপাসক নেই। তুমি পবিত্র। আর নিশ্চয়ই আমি সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা আম্বিয়া : ৮৭)। তাঁর এ অকপট স্বীকারোক্তি ও ক্ষমা প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন এবং তাঁকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।

মহানবী (সা.)-এর একজন খাদেম ছিলেন রাবিআহ আল-আসলামি (রা.)। একবার আল্লাহর রাসুল (সা.) তাকে এবং আবু বকর (রা.)-কে এক খণ্ড জমি দান করেন। কিছু দিন পর তাদের জমির সীমানায় থাকা একটি খেজুরের কাঁদি নিয়ে দুজনের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্কের একপর্যায়ে আবু বকর (রা.) রাবিআহ (রা.)-কে এমন একটি কথা বলেন, যা তার জন্য খুবই পীড়াদায়ক ছিল। কিন্তু কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আবু বকর (রা.) প্রচণ্ড অনুতপ্ত হন। তিনি রাবিআহ (রা.)-কে অনুরোধ করেন, ‘তুমিও আমাকে ঠিক একইরকম কথা বলে প্রতিশোধ নাও, যাতে আমার মন্দ কথার বিচার (কিসাস) হয়ে যায়।’ কিন্তু রাবিআহ (রা.) এ মহৎ মানুষটির প্রতি প্রতিশোধ নিতে অস্বীকৃতি জানান। আবু বকর (রা.) বলেন, তুমি অবশ্যই (আমাকে মন্দ কথা) বলবে নতুবা তোমার বিরুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নালিশ করব। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানান। আবু বকর (রা.) আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে যান। একটু পর রাবিআহ (রা.)-ও রওনা হন। পথে তার গোত্রের লোকেরা তাকে আবু বকরের বিরুদ্ধে সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তাদের বারণ করেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি জানো তিনি কে? তিনি আবু বকর সিদ্দিক। তার ক্রোধের কারণে রাসুল (সা.) ক্রোধান্বিত হবেন আর তাদের দুজনের ক্রোধের কারণে আল্লাহ ক্রোধান্বিত হবেন, ফলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব।’

অবশেষে তারা দুজনই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পৌঁছান। সব শুনে আল্লাহর রাসুল (সা.) রাবিআহ (রা.)-কে বলেন, ‘না, তুমি তার কথার জবাবে কটু কথা বলবে না, বরং তুমি বলো, হে আবু বকর! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিন।’ রাসুল (সা.)-এর এই মহান শিক্ষা শ্রবণ করে আবু বকর (রা.) কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন। (মুসনাদ আহমাদ : ১৬৬২৭)।

ভুল স্বীকার না করার পরিণতি ভালো হয় না। যে ব্যক্তি ভুল স্বীকার করে না, তার ভুল তাকে নতুন ভুলের দিকে নিয়ে যায়। সে তার ভুল থেকে শিখতে পারে না। ফলে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে এবং এতে তার বিকাশ ও অগ্রযাত্রা থেমে যায়। আবার ক্রমাগত ভুল অস্বীকার করার ফলে ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের মিথ্যা অহমিকা তৈরি হয়। সে নিজেকে নির্ভুল ভাবতে শুরু করে, এটি তার ধ্বংস ডেকে আনে। মোটকথা, ভুল স্বীকার করা দুর্বলতা নয়, বরং এটি এক ধরনের শক্তি, যা মানুষকে নৈতিকভাবে বলীয়ান করে তোলে। যে ব্যক্তি ভুল স্বীকার করাকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হিসেবে দেখে, সেই ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে এগিয়ে যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত