ঢাকা বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২৩৮)

ভণ্ড সুফির বীরত্বের অহমিকা ফাঁস

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
ভণ্ড সুফির বীরত্বের অহমিকা ফাঁস

তিনি সুফি। বড় বুযুর্গ। চারিদিকে নাম ডাক। সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হয়েছেন। নাদুস নুদুস শরীর এখন। তার দাবি, কৃচ্ছতার গুণে তিনি কামিল। ভক্তরা এক ধাপ এগিয়ে বলেন, তিনি শুধু কামিল নন, মুকাম্মিল। নিজে পরিপূর্ণ মানুষ। তদুপরি অন্যরা কামিল হয় তার সাহচর্যে এলে। বহ্যিক বেশভূষায় পীরজাদা পীর ছাহেব। তবে ভেতরে সদরঘাট। হাকিকী প্রেমের কিছুই পাননি। তারপরও সাধারণ মানুষের ভক্তি কুড়াতে নিজেকে জাহির করেন দ্বীনের বড় খাদেমরূপে। তার মনে ব্যথা, সমঝদার লোকেরা কেন তার শান-মান মানে না। তাসাউফের মাজেযা বুঝে না।

আল্লাহর দীনের মুজাহিদ, যারা শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াইয়ে জান বাজি রাখে তাদের জিহাদ তো ছোট জিহাদ, জিহাদে আসগর। আর আমি যে জিহাদ করি তার নাম বড় জিহাদ, জিহাদে আকবর। আমার বুজুর্গি এবার দেখাতে হবে সম্মুখ লড়াইয়ে যুদ্ধরত মুজাহিদদের সম্মুখে। এক যোদ্ধাকে ডেকে একদিন বললেন, আপনারা যখন যুদ্ধে যাবেন আমাকেও নিয়ে যাবেন। যুদ্ধের ময়দানে এই দরবেশের বীরত্ব প্রমাণ করতে চাই।

এরিমধ্যে দেশময় সাড়া পড়ে গেল, দেশ বাইরের শত্রু আক্রান্ত হয়েছে। ঘোষণা এলো সবাই রণসাজে সজ্জিত হও। সুফি ছাহেবও যুদ্ধের পোশাক নিলেন। হাতে তার তরবারি। বড় সাজগোজ নিয়ে সুফিজি যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। সম্মুখ লড়াইয়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি। আকাশে বিদ্যুতের মতো তলোয়ার চমকায়। অশ্বের পদাঘাতে ধুলির কুণ্ডলি যেন মরু সাহারার সাইমুম ঝড়। ঘোড়ার হ্রেস্বারবে তুমুল হট্টগোল। রণহুঙ্কার দেখে সুফিজির পিলে চমকে গেল। এমন কাঁপন শুরু হলো, হাতে তরবারি ধরে রাখা ভার। একটা অজুহাত সাজিয়ে সুফি চলে গেলেন রণাঙ্গনের পেছনে রসদের কাছে। ঘোরতর লড়াই হল। লড়াকু মুজাহিদরা জান বাজি রেখে বীরত্বের প্রমাণ দিল। শেষে ইসলামী বাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হলো। বহু গণিমত, যুদ্ধবন্দি নিয়ে তারা ফেরত এলেন তাঁবুতে।

পরিস্থিতি শান্ত হলে যুদ্ধলব্ধ মাল থেকে ভাগের ভাগ সামান্য কিছু সুফিকেও দিলেন মুজাহিদগণ। কিন্তু সুফি ওসব গণিমত দূরে ছুড়ে মারলেন। কিছুই রাখলেন না নিজের জন্য। এমন ব্যবহারে অনেকটা বিস্মিত হলেন মুজাহিদগণ। জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী? আপনি গণিমতলব্ধ মাল ওভাবে ছুড়ে ফেললেন কেন? সুফি বললেন, এর কারণ, আমার আফসোস হলো, জিহাদ করার সুযোগটাই পেলাম না। লড়াইয়ের সুযোগ পেলে দেখতেন কীভাবে শত্রুনিধন করি, শত্রুর ব্যুহ তছনছ করার দক্ষতা দেখাতে পারলাম না- এই আমার আফসোস।

সুফি যুদ্ধের কোনো ঝুঁকি তো নিলেন না; তদুপরি বন্ধুরা যে মমতা দেখাল, গণিমতের মালে ভাগ দিল, তাতেও খুশি হলেন না। বড় বড় আস্ফালন দেখিয়ে নিজের বুজুুর্গি জাহির করতে লাগলেন। মুজাহিদগণ বললেন, হযরত! হাহুতাশ করার দরকার নেই। যুদ্ধ করার সুযোগ হয়নি তাতে কী। বিকল্প আরেকটা পথ আছে। যুদ্ধ বন্দিদের মধ্যে একজন দুষ্ট সৈনিক আছে, দুহাত মোড়ানো। আপনি তাকে নিয়ে বধ্যভূমিতে যান। তার দুই হাত শক্তভাবে বাঁধা আছে। আপনার তরবারি দিয়ে তার শিরটা দ্বিখণ্ডিত করে আসেন। প্রস্তাবটি শুনে সুফি উৎফুল্ল। একটু হলেও নিজের বীরত্ব, বুজুর্গির প্রমাণ দিতে পারবেন।

অহমিকায় টগবগে সুফি শত্রু সেনাকে নিয়ে গেলেন আস্তাবলের কাছে। সেখানেই বধ্যভূমি, শত্রুসৈন্যকে হত্যা করার জায়গা। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মুজাহিদরা লক্ষ্য করলেন, সুফি ছাহেব এখনো ফিরেননি। তার এত বিলম্ব করার কারণ কী? কাফের শত্রুসৈন্যটির তো দুই হাত বাঁধা। ওকে হত্যা করতে এতক্ষণ লাগে। একজন মুজাহিদ দ্রুত তার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে, অবাককাণ্ড। কাফের সৈন্যটি চেপে বসে আছে সুফির বুকের উপর। শত্রু সেনা দুই হাত বন্ধ থাকায় কিছুই করতে পারছে না। তবে বিড়ালের মতো মুখ দিয়ে কামড়াচ্ছিল সুফির গলায়। সুফি তখন বেহুঁশ, নিথর। তার দাঁড়িমুখ রক্তাক্ত। মওলানা রুমি বলেন, ব্যাপারটি তোমার মতোই। তোমার ভেতরে যে নফসে আম্মারা, তার দুই হাত বন্ধ রাখা হয়েছে তোমার বিবেক জ্ঞানবুদ্ধি ও শরীয়তের রশি দিয়ে। এরপরও নফসে আম্মারার আঁছড়ে তুমি তুচ্ছ অপদস্থ দিশাহারা।

হামচো তো কায দস্তে নফসে বস্তে দাস্ত

হামচো অ’ন সুফি শুদি বী খেশ ও পাস্ত

তোমার মতোই, হাতবাঁধা নফসের পাঞ্জায়

বিক্ষত লাঞ্ছিত সুফির মতো সম্বিতহারা অসহায়।

তোমার ভেতরের নফসে আম্মারা, সেই যুদ্ধবন্দির মতো, যার দুই হাত বাঁধা এবং নামধারী সুফিকে ধরাশায়ী করে তার বুকের উপর চেপে বসেছিল। নফসে আম্মারা- যার অবস্থান তোমার সত্তার মধ্যে, তার হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে দুটি রশি দিয়ে। একটি রশি তোমার জ্ঞানবুদ্ধি বিবেক, আরেকটি রশি শরীয়তের বিধিনিষেধ। কাজেই সাধক যখন সাহস করে তখনই নফসে আম্মারার উপর বিজয়ী হতে পারে। নফসে আম্মারার অবস্থা হলো, যে লোক আত্মভোলা, দায়িত্বজ্ঞানহীন, সাহসহারা, উদ্যমহীন, হাবাগোবা তার উপর সে বিজয়ী হয়। তাকে ধরাশায়ী করে বুকের উপর চেপে বসে। কিন্তু ঈমানী চেতনায় বলিয়ান তাকওয়ার বর্মে সজ্জিত লোকের সামনে নফস বিনীত ও কাবু হয়ে যায়। চিন্তা কর, তুমি কত দুর্বল। তোমার দ্বীন ও ঈমানের শক্তি কেমন? সাধনার পথে একটি টিলাও তো পার হতে পারবে না। অথচ তোমার সম্মুখে বহু দুর্গম গিরিসংকট।

সুফির বেহাল অবস্থা দেখে গাজীগণ তড়িৎ হস্তক্ষেপ করলেন। তরবারির আঘাতে সুফির বুকের উপর চেপে বসা শত্রুসৈন্যকে হত্যা করলেন। তারপর সুফির মুখে পানি আর গোলাপজল ছিঁটালেন। সুফির হুঁশ ফিরে এলো। জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি দেখেন, অনেক লোকজন তাকে নিয়ে ব্যস্ত। তাদের কাছে জানতে চাইলেন, আমার কী হয়েছিল। লোকেরা বলল, একজন হাতবাঁধা যুদ্ধবন্দি আপনার বুকের উপর চেপে বসেছিল, আর আপনাকে সমানে কামড়াচ্ছিল। তারপর তারা সুফির কাছে জানতে চান ঘটনার আদ্যোপান্ত।

সুফি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললেন, আপনাদের কথা মতো আমি যখন যুদ্ধবন্দি নিয়ে আস্তাবলের কাছে গেলাম, সে এমন তির্যকভাবে শ্যান দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল যে, ভয়ে আতঙ্কে আমি হুঁশজ্ঞান হারালাম। সে যখন আমার দিকে ক্রোধান্বিত হয়ে চোখ ঘুরাল, মনে হলো একদল সিপাহী আমাকে ঘিরে ফেলল। তখনই আমি হুঁশজ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।

মুজাহিদরা বললেন, সুফি ছাহেব! একটি কথা মনে রাখবেন, আপনার যে সাহস মনোবল, বুকের পাটা তা নিয়ে কখনো লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হবেন না। হাতবাঁধা একজন যুদ্ধবন্দির চাহনির ত্যেজ আপনি সহ্য করতে পারেন নি, শত্রুবাহিনী যখন ব্যঘ্রমূর্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তখন আপনার অবস্থা কেমন হবে ভেবে দেখুন। যুদ্ধ করতে হলে পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে। ভোগের রাজ্যে যদি নফসের খোরাক যোগাতে ব্যস্ত থাকেন, শরীরটা নাদুস নুদুস হবে সত্য, কিন্তু রাতের বিছানায় ঘরের কোনায় ইঁদুর খসখস করলে পিলে চমকে উঠবে। যুদ্ধ করতে হলে হযরত আমীর হামজার বীরত্ব চাই। ইস্পাত কঠিন মনোবল থাকা চাই। মুখে বুজুর্গির দাবি নয়, যদি আত্মসংযম ও তাকওয়ার অস্ত্রে সজ্জিত না হও, তাহলে তুমি ইসলামের জন্য যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে পারবে না। নফস তোমার করায়ত্বে আছে- এটি তোমার মুখের দাবি। খ্যাতির মোহ যেভাবে তোমাকে বেসামাল করে রেখেছে তাতে জান ও মালের ত্যাগ স্বীকারের চেতনা তোমার মধ্যে কখনও জাগ্রত হবে না।

নীস্ত হামযা খোরদন ইনজা’ তীগ বীন

হামযাঈ বা’য়দ দর ইন সফ আহানীন

কুরমা পোলাও নয় এখানে দেখ তরবারির ঝলকানি

ইস্পাত কঠিন প্রত্যয় চাই, হামযার মতো বীর সেনানি।

যার মন ছাগলের মতো, সে কি পারে আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রাণ বাজি রাখতে? কাজেই শুরু থেকে তোমার মধ্যে লালন কর, বীরত্ব, সত্যনিষ্ঠা, নফসকে বশীভূত রাখার কর্মপন্থা। মওলানার ভাষায় সুফি তো নামধাম, খ্যাতি, বুজুর্গির ঢোল পেটানো, জাহেরী ঝাঁকজমকের নাম নয়; সুফি সেই লোক যে কামনার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছে, যদিও সুফির মতো বেশভূষা তার নেই, তাসাউফের রসম রেওয়াজের তোয়াক্কা সে করে না। আর যারা ভন্ড সুফি তাদের কারণে সত্যিকার সুফিরাও দুর্নামের ভাগী হন। সে তথ্যটি জানতে পারব আগামী গল্পে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরীফের গল্প, ৫খ. ব: ৩৭৪০-৩৭৭৯)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরীফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত