ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/৩)

চোরের যুক্তিবিন্যাসে অপার সৃষ্টিরহস্য

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
চোরের যুক্তিবিন্যাসে অপার সৃষ্টিরহস্য

এক চোর গৃহস্থের বাড়িতে ঢুকেছিল অমাবশ্যার রাতে। কারও পায়ের শব্দ আঁচ করতে পেরে গৃহস্থের ঘুম ভেঙে যায়। বিছানার কাছে রাখা চকমকি পাথরে ঘষা দিয়ে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করে গৃহস্থ। অতীতে আগুন ধরাতে দিয়াশলাইর পরিবর্তে চকমকি পাথরের ব্যবহার ছিল ব্যাপক। অবস্থা আঁচ করতে পেরে চোর নিঃশব্দে গৃহস্থের সামনে এসে বসে পড়ল। গৃহস্থ মাটির কুপি চেরাগে আগুন দিয়ে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু চকমকি পাথরে ঘষায় আগুন ঝিলিক দিয়ে ওঠতেই চোর হাতের ইশারায় তা নিভিয়ে দেয়। নিকষ অন্ধকারের কারণে গৃহস্থ তার সামনে বসা চোরকে দেখতে পেল না। ভাবল, চকমকি পাথর বুঝি স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে; কিংবা চেরাগের সলতের মধ্যে কেরোসিন নেই। তাই আগুন ধরানো যাচ্ছে না।

ইন চুনিন আতাশ কুশি আন্দর দিলাশ

দিদায়ে কাফের নবিনদ আজ আমাশ

কাফেরের অন্তরে আলো নিভানোর এমনই কসরত

অন্ধত্বের কারণে সমর্থ হয় না বুঝতে এর হাকিকত।

মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, কাফের নাস্তিকের মনের বাড়ির আলো নিভে যাওয়ার কারণও এখান থেকে বুঝে নাও। তাদের মনের বাড়িতে যদি আলো থাকত, তাহলে বিশ্বব্যবস্থায় বিরাজমান রহস্যগুলো বুঝতে পারত এবং সেই আলোতে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারত। মনের বাড়ির আলো বলতে কি বুঝায়? সেই আলো হচ্ছে সততা ও স্বচ্ছতা। সততা ও স্বচ্ছতার অভাবে কাফের নাস্তিকের মনের বাড়ি আঁধারে আচ্ছন্ন। ফলে আলো জ্বালানোর চেষ্টা আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন। পাপী নাফরমানরাও তওবা করে, যাদের তওবায় সততা, স্বচ্ছতা, পাপ বর্জনের দৃঢ় সংকল্প থাকে না, তাদের তওবা আল্লাহ কবুল করেন না। এ কারণে তাদের মনের বাড়িতেও প্রদীপ জ্বলে না।

পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত অবলম্বনে মওলানা এই জীবনদর্শন উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যখনই তারা (ইহুদির) যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছে, আল্লাহ সে আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন। তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির চেষ্টা করে। আর আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না (ফলে তারা সফলকাম হতে পারে না।)’ (সুরা মায়েদা : ৬৪)।

আয়াতটি কাফেরদের যুদ্ধাংদেহী চরিত্র সম্পর্কিত। কিন্তু মওলানা রুমি (রহ.) তার নিজস্ব নিয়মে এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং আমাদের চিন্তা, আকিদা ও বিশ্বাসের জন্য একটি মাইলফলক নির্মাণ করেছেন। সেই জীবনদর্শন হলো, অনেক মানুষ বারবার সিদ্ধান্ত নেয়, অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে আসবে, মন্দ কাজ ত্যাগ করে সৎপথের পথিক হবে। এরপরও কেন তারা পথ খুঁজে পায় না? মওলানা বলেন, এর কারণ, তাদের চাওয়ার মধ্যে নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতা থাকে না। তাদের মন থাকে নড়বড়ে। সংকল্প থাকে দোদুল্যমান। আল্লাহর শ্বাশ্বত নিয়ম হলো, যাদের অন্তরে সততা ও স্বচ্ছতা নেই, সৎপথে চলার দৃঢ় প্রত্যয় নেই, তাদের তিনি সৎপথে পরিচালিত করেন না। এ কারণেই তারা সত্যের পথ খুঁজে পায় না।

বান্দার হেদায়তের প্রকৃত মালিক আল্লাহতায়ালা। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। কিন্তু কাফের ও নাস্তিকরা মন আঁধিয়ারায় আচ্ছন্ন থাকায় আল্লাহর অস্তিত্ব দেখতে পায় না, বান্দার জীবন প্রণালীর ওপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করতে চায় না। তারা বিশ্বব্যবস্থায় নানা ঘটনা প্রবাহের পেছনে কার্যকারণ তত্ত্বেই বিশ্বাসী। সৃষ্টিলোকে সকল কার্যকারণের অন্তরালে যে আদি কারণ ক্রিয়াশীল তা তারা বুঝতে পারে না। ফলে স্রষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে খুঁজে পায় না। মওলানা রুমি (রহ.) এসব নাস্তিক কাফেরের চোখ খুলে দিতে চান উপমার পর উপমা সাজিয়ে।

এই যে দিন ও রাতের পালাক্রমে আগমন, একজন স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রকের নিখুঁত ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে তা কি সম্ভব?

তুমি যুক্তিবাদী। যুক্তিতে বিশ্ব¦াসী। কী কারণে কী হলো, কীভাবে হলো এসব নিয়ে যুক্তির জাল বুনো। বস্তুর বাহ্যিক কারণ বিশ্লেষণে তোমার ধ্যানজ্ঞান নিয়োজিত। আমার প্রশ্ন, দিন রাতের পালাক্রমে আগমন, ঋতুচক্রের বিবর্তন, গ্রহ-নক্ষত্র চাঁদ সূর্যের পরিক্রমণ একজন স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক ছাড়া সুশৃঙ্খলভাবে কি করে সম্ভব? কাজেই তুমি যদি মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার কর বুঝতে হবে, তুমি আসলে বুদ্ধিজীবী বা যুক্তিবাদী নও; বরং আহাম্মকের স্বর্গেই তোমার বসবাস। একটি কথার জবাব দাও।

খানা বা বান্না বুয়াদ মাকুলতার

য়াবে বি বান্না বগু আই কম হুনার

বাড়ির নির্মাতা আছে স্বীকার করাই কি যুক্তিপূর্ণ হবে

নাকি নির্মাতা ছাড়াই বাড়ি হয়েছে বলা যুক্তিসঙ্গত হবে?

দূর আকাশের কথা নয়, তোমার ঘরের কথাই চিন্তা করো। তোমার সুন্দর ঘরটি বা তার রকমারি ফার্নিচার কোনো নির্মাতা ছাড়া নির্মিত হয়েছে বলা কি যুক্তিপূর্ণ হবে, নাকি একজন স্থপতি, শিল্পী কারিগর নির্মাণ করেছেন বলাটা যুক্তি ও বিজ্ঞতার পরিচায়ক হবে?

আরও সহজ হিসেবে এসো।

খাত্ত বা কাতেব বুয়াদ মাকুলতার

য়াকে বি কাতেব বিয়ান্দিশ আই পেসার

লেখা লেখক বিনে লিখিত বলাই কি যুক্তিযুক্ত

নাকি লেখক লিখেছেন বলা যুক্তিপূর্ণ, বলো বৎস।

তোমার সামনে যে কাগজ, তার ওপর আঁকাবাঁকা রেখা। এগুলোর নাম লেখা। এই লেখা ও রেখা কোনো লেখক ছাড়াই কাগজের গায়ে অঙ্কিত হয়েছে- এমন কথা বলা কি যুক্তিযুক্ত হবে, নাকি একজন লেখকের কলমের আঁচড়ে এগুলো সৃষ্টি হয়েছে বলা অধিক সুন্দর, সত্য ও যুক্তিপূর্ণ হবে?

তোমার নিজের দিকে তাকাও। মাথার দুপাশে শোনার জন্য দুটি কান, দেখার জন্য সম্মুখে দুটি চোখ এবং খাওয়া-কথা বলার জন্য একটি মুখ আছে, এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কোনো স্রষ্টা ছাড়াই এমনিতে স্থাপিত হয়েছে বলা কি যুক্তিসঙ্গত হবে, নাকি একজন সুনিপুণ শিল্পী স্রষ্টার ব্যবস্থাপনায় এগুলো মানব দেহে স্থাপিত হয়েছে বলা অধিক যুক্তিপূর্ণ ও সত্য হবে?

এবার তোমার চারপাশে তাকিয়ে দেখ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসাতে ঘরে ঘরে চেরাগ জ্বলে ওঠে। এই চেরাগ নিজে নিজে জ্বলে ওঠে বলা কি তোমার যুক্তিবাদীতার প্রমাণ হবে, নাকি কোনো অগ্নিসংযোগকারীর ইশারায় এসব প্রদীপ জ্বলে বলা যুক্তির দাবি, সুন্দর ও সত্য হবে?

চিত্রশিল্পীরা মনের অনুরাগ মেখে ছবি আঁকে। সেই চিত্রকর্ম দেখে দর্শকরা ভাব ও চেতনায় তন্ময় হয়। এটিই সত্য কথা। এখন যদি বলা হয়, চিত্রকর্মটি এমনিতে সৃষ্টি হয়েছে, কোনো শিল্পীর তুলির আঁচড় লাগেনি- তা কি যুক্তিবুদ্ধির কথা হবে? নাকি কোনো শিল্পীর তুলির কারিশমায় চিত্রকর্মটি মনোমুগ্ধকর হয়েছে বলাই বুদ্ধির সঙ্গে যুৎসই হবে? মুক্তবুদ্ধির দাবিদাররা জবাব দেবেন কি?

এতকিছুর পরও যাদের জ্ঞানের চোখ খুলে না, মওলানা রুমি তাদের প্রতি দারুণ রুষ্ট। তাই তিনি বলেন, তোমার ওপর যখন আল্লাহর গজব নাজিল হয়, নানা বিপদ তোমাকে ঘিরে ধরে তখন তুমি কি চিন্তা কর, তখন কি মনে কর যে, বিপদণ্ডআপদ এমনিতে আপতিত হয়েছে? তার পেছনে একজন স্রষ্টার হাত নেই। তাহলে বিপদ দূর করার ব্যবস্থা কেন করো না? তুমি সবকিছুতে প্রাকৃতিক নিয়ম খুঁজো। প্রকৃতির বিরুদ্ধে কেন লড়তে যাও না? এতে প্রমাণ হয়, তুমি এ কথা মান যে, বিশ্বব্যবস্থায় এমন এক মহাশক্তি আছেন, যার দ্বারা তুমি নিয়ন্ত্রিত। তার নিয়ন্ত্রণ ও আওতার বাইরে যাওয়ার সাধ্য তোমার নেই।

তোমার যখন অস্তিত্ব ছিল না, নিঃসীম অনস্তিত্বের মাঝে বিলীন ছিলে তখনও তুমি তারই নিয়ন্ত্রণে ছিলে। সেখান থেকে বের হওয়ার ক্ষমতা তোমার ছিল না। তার দয়ায় এখানে আসার পর কেন তাকে অস্বীকার করো? তার রাজত্ব ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অনর্থক চেষ্টা চালাও? তার আদেশ-নিষেধ অমান্য করার মানেই হলো, তাকে অস্বীকার করা, তার রাজত্ব অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করা। যখন দেখতে পাচ্ছ যে, তার রাজত্ব ছেড়ে বাইরে যাওয়ার উপায় নেই, তখন তো একটি পথই খোলা থাকে। তাহলো তার ইবাদত ও আনুগত্যে আত্মনিয়োগ করা। তার ইচ্ছা অনুযায়ী তোমার জীবনকে সাজানো। অথচ তুমি তাকে ছেড়ে দুনিয়ার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছ। জেনে রেখ যে-

ইন জাহান দাম আস্ত ও দানাশ আরজু

দরগুরিজ আজ দামহা রুয় আর আজু

এ জগত ফাঁদ তাতে কামনা-বাসনা ছড়ানো দানা

এই ফাঁদ ছেড়ে পালাও, তিনিই তোমার ঠিকানা।

আল্লাহকে অস্বীকার বা ভুলে যাওয়া মানে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ততা। আর দুনিয়ার স্বরূপ হলো তোমার সামনে পাতানো ফাঁদ। শিকার ধরার জন্য পাতানো জালে দানা ছড়ানো হয়। দুনিয়া নামক জালে আটকানোর ছড়ানো দানা হলো তোমার প্রবৃত্তির কামনা বাসনা। তুমি কামনা-বাসনা ও অলীক কল্পনাবিলাস ছেড়ে তার কাছে যাও।

চোন চুনিন রাফতি বেদিদি চদ গুশাদ

চোন শুদি দর জিদ্দে আন দিদি ফসাদ

যদি যাও তার কাছে পাবে শত প্রফুল্লতা

যদি যাও তার বিরুদ্ধে দেখবে যতসব বাধা।

আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকারের মূলনীতির ভিত্তিতে যখন তোমার জীবনকে ঢেলে সাজাবে, তখন তোমার জীবনের নানা সমস্যা ও জটিলতার ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে। জগত ও জীবন নিয়ে নানা অসঙ্গতি দূর হয়ে যাবে। মনে হবে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নন্দন কাননে বিচরণ করছি। আর যদি তাকে অস্বীকার করার নীতিতে জীবন অতিবাহিত করতে চাও, তাহলে জীবন-জগতের সঠিক ব্যাখ্যা তুমি খুঁজে পাবে না। হাজারো রকমের জটিলতায় জড়িয়ে যাবে। এসব বিষয় হৃদয়ঙ্গমের জন্য তোমাকে তোমার বিবেকের আশ্রয় নিতে হবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার বিবেকের কাছে জিজ্ঞাসা করে পথ চল। যদিও জ্ঞানী ব্যক্তিরা তার বিপরীত কথা বলেন।’ বিবেকের পরামর্শে চলতে হলে নিজের কথা, কাজ ও আচরণ হতে হবে হিসাব-নিকাশ করে।

দম বদম চোন তো মোরাকেব মি শাওয়ি

দাদ মি বিনি ও দাওয়ার আই গওয়ি

প্রতি মুহূর্তে যদি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখ

পাবে আল্লাহর সুবিচার সৎকর্মের সুফল অবিরত।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৬ খণ্ড বয়েত-৩৫৭-৩৮৪)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবীর গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত