আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহকে ভয় করার অর্থ হলো, তাঁর আদেশ মানা ও তাঁর নিষেধকৃত কাজগুলো থেকে দূরে থাকা। কারণ, আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন, আর তিনি উত্তম পরিণাম রেখেছেন তাকওয়ার অধিকারী খোদাভীরুদের জন্যই। তাকওয়া হলো দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ পাওয়ার মূল চাবিকাঠি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, ‘আমি কি তোমাদের এ সব বস্তু থেকে উৎকৃষ্টতর কোনো কিছুর সংবাদ দেব? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্যে তাদের প্রতিপালকের নিকট জান্নাতগুলো রয়েছে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। আর সেখানে তারা স্থায়ী হবে, তাদের জন্যে পবিত্র সঙ্গিনীরা ও আল্লাহর কাছ থেকে সন্তুষ্টি রয়েছে। আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘যদি সেই সকল জনপদের অধিবাসীবৃন্দ ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের জন্যে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করতাম।’ (সুরা আরাফ : ৯৬)।
আল্লাহ সব মানুষকে তাকওয়ার ব্যাপারে একে অপরকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সহযোগিতা করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা মায়িদা : ২)।
আল্লাহভীতি মানে হলো, প্রতিদান লাভের আশায় ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর দ্বীনকে আঁকড়ে ধরা ও তাঁর শরিয়তের অনুসরণ করা। আল্লাহ বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্যে তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়িদা : ৩)।
ইসলামের তিনটি স্তর রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু স্তর হলো ইহসান বা দয়া। আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) ইহসানের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘ইহসান হলো, তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করো, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। আর যদি তা না পারো, তবে জেনে রাখো, তিনি তো তোমাকে দেখছেন।’ (বোখারি : ৫০)।
ইসলামের দ্বিতীয় স্তর হলো ঈমান। ঈমান হচ্ছে- মুখে বলা, অন্তরে বিশ্বাস করা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে কাজ করা। ঈমান ইবাদতের মাধ্যমে বাড়ে ও গোনাহের মাধ্যমে কমে যায়। ঈমানের শাখা রয়েছে সত্তরেরও বেশি। এর সবচেয়ে উঁচু শাখা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, আর সবচেয়ে নিচু শাখা হলো, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া। লজ্জাও ঈমানের একটি শাখা।
ঈমানের অন্তর্ভুক্ত হলো, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, সত্য কথা বলা, ভালো ও মিষ্টি ভাষায় কথা বলা, প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি রক্ষা করা এবং উত্তম চরিত্র অবলম্বন করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তাঁর শরিক করবে না। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।’ (সুরা নিসা : ৩৬)।
ঈমানের অংশ হলো, নিয়ামত লাভের সময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, বিপদের সময় ধৈর্যধারণ করা, গোনাহ ও অবাধ্যতার পর তওবা ও অনুতাপ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধৈর্যশীলদের অপরিমিত পুরস্কার দেওয়া হবে।’ (সুরা জুমার : ১০)।
ঈমানের ছয়টি মূলভিত্তি রয়েছে। এক. আল্লাহর প্রতি ঈমান। দুই. তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান। তিন. তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান। তাঁর রাসুলদের প্রতি ঈমান। পাঁচ. পরকালের প্রতি ঈমান। ছয়. ৬. তাকদিরের ভালো-মন্দ উভয়ের প্রতি ঈমান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সমস্ত কিতাব ও নবীগণে ঈমান আনয়ন করলে।’ (সুরা বাকারা : ১৭৭)।
ঈমানের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাত- উভয় জগতের কল্যাণ ও সফলতা লাভ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের- যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং স্থায়ী জান্নাতে উত্তম বাসস্থানের। আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ আর এটাই মহাসাফল্য।’ (সুরা তওবা : ৭২)।
আল্লাহর প্রতি ঈমান মানে হলো, তাঁকে একক সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, পরিচালনাকারী, সর্বোচ্চ গুণ ও সুন্দরতম নামের অধিকারী হিসেবে মানা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন; এরপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনিই দিনকে রাত দিয়ে আচ্ছাদিত করেন যাতে এদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে; আর সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্ররাজি- যা তাঁরই আজ্ঞাধীন, তা তিনিই সৃষ্টি করেছেন। জেনে রাখ, সৃজন ও আজ্ঞা তাঁরই। মহিমময় বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ। তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক; তিনি সীমালংঘন-কারীদের পছন্দ করেন না। দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় ঘটিও না, তাঁকে ভয় ও আশার সঙ্গে ডাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী।’ (সুরা আরাফ : ৫৪-৫৬)।
ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনয়নও ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর দোজখ থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মমহৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাদের আদেশ করেন। আর তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তাই করে।’ (সুরা তাহরিম : ৬)।
আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান- যেমন তাওরাত, ইনজিল, জবুর ও অন্যান্য কিতাব, যেগুলো তিনি তাঁর নবীদের ওপর নাজিল করেছেন। আল্লাহ সবগুলোর ওপর কোরআনকে শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ গ্রন্থ এবং সত্যের মানদ- হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
আল্লাহর সব নবীর প্রতি বিশ্বাস রাখাও ঈমানের অংশ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘রাসুল, তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে। আর মুমিনগণের সকলে আল্লাহে, তাঁর ফেরেশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে ও তাঁর রাসুলগণে ঈমান এনেছে। তারা বলে, আমরা তাঁর রাসুলগণের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না।’ (সুরা বাকারা : ২৮৫)।
পরকালে বিশ্বাস রাখাও ঈমানের অংশ। পরকাল মানে কিয়ামতের দিন, হিসাব-নিকাশের দিন- যেদিন আল্লাহর বন্ধুদের জন্য থাকবে জান্নাত এবং তাঁর শত্রুদের জন্য থাকবে জাহান্নামের শাস্তি।
তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস রাখাও ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ নবীর জন্য যা বিধিসম্মত করেছেন তা করতে তার জন্য কোনো বাধা নেই। আগে যেসব নবী অতীত হয়ে গেছে, তাদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহর বিধান। আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত।’ (সুরা আহজাব : ৩৮)।
অনুবাদ : আবদুল কাইয়ুম শেখ