এক শিকারি মাথায় ও গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে গুপটি মেরে বসেছিল ঝোপের ভেতর। খাবারের খোঁজে উড়ন্ত এক পাখি পাতানো জালের কাছে দেখে ফেলে শিকারির কৌশল। পাখি জানতে চায়, ঝোপের মাঝে কিসের তপস্যা করেন? জবাবে শিকারি বলে, সংসারে মানুষের ব্যবহারে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বৈরাগ্যের জীবন অবলম্বন করেছি। একদিন যেহেতু মরতেই হবে আগে থেকে তাই মরণের সাধনা করছি। শিকারির বৈরাগ্য জীবনের ছলাকলার কথা শুনে পাখি উপদেশ শোনায়, হে ভদ্রলোক, নির্জন সাধনায় বসে থেকো না। মুহাম্মাদি ধর্মে বৈরাগ্য নেই জান না? সংসার জীবন ছেড়ে বৈরাগ্য বরণ নিষেধ করেছেন আল্লাহর নবী। ইসলামে নতুন বেদাতের প্রবর্তন করছেন কোন যুক্তির বলে, তুমি কি জান না যে-
জুমআ শর্ত আস্ত ও জামাআত দর নামাজ
আমরে মারুফ ও জে মুনকার এহতেরাজ
ইসলামে জুমা শর্ত নামাজ চাই জামাত সহকারে
সৎকাজের আদেশ অসৎকাজে নিষেধ করতে হবে।
সত্যিকার ইসলামি জীবনযাপন করতে হলে সংসার ছেড়ে বৈরাগ্য জীবন জায়েজ নেই। এ জন্যে জুমার নামাজ সাপ্তাহিক সম্মেলনের আকারে হওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। নামাজ যদিও নিখাদ আল্লাহর ইবাদত তবুও তা সম্মিলিত জামাতবদ্ধভাবে আদায় করার বিধান দেওয়া হয়েছে। অনুরূপ সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব পালন করতে হবে জাতীয়ভাবে। কাজেই সমাজ ছেড়ে পালিয়ে নির্জন সাধনায় আধ্যাত্মিক উন্নতির সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলামে সাধনা ও কৃচ্ছ্রতার মূলকথা ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখানো। একাকী জীবনে তো ধৈর্যধারণের সুযোগ আসে না। মন্দ লোকদের পক্ষ থেকে যখন দুঃখ-কষ্ট আপতিত হবে, তখনই তো ধৈর্যের পরীক্ষা ও পরিচয় হবে।
রঞ্জে বদখাহান কশিদান জিরে সবর
মোনফাআত দাদন বে খলকান হামচো আবর
দুষ্ট লোকদের দুঃখ-যাতনা সওয়া ধৈর্যের পাহাড় চেপে
সৃষ্টির উপকার সাধন ব্রত হোক তোমার, মেঘের মতো।
এটিই ইসলামের শিক্ষা। প্রিয় নবীজির নির্দেশনা ও আচরিত সুন্নাতের আদর্শ এটাই। তুমি কি শোনোনি, তিনি যে বলেছেন-
খাইরু নাস আঁই ইয়ানফাউন্নাস আই পেদার
গর ন সঙ্গি চে হারিফি বা মদর
উত্তম মানুষ তো সে, যে মানুষের উপকার করে
পাথর না হলে বনে পাথরের আত্মীয় কেন হলে।
হাদিসে আছে, উত্তম মানুষ সে ব্যক্তি যে মানুষের বেশি উপকার করে। তুমি সে বাণী ভুলে কেন পাহাড়ে এসেছ পাথরের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়তে। তোমার বাইরের খোলস খুলে ফেললে দেখবে, তুমিও পাথর কুলুকের মতো জমাট নিথর পাথর। তাই মানুষের সঙ্গ ছেড়ে চলে এসেছ পাথরের দেশে বন-প্রান্তরে। এখন যদি মুক্তি চাও-
দরমিয়ানে উম্মতে মরহুম বাশ
সুন্নাতে আহমদ মাহেল মাহকুম বাশ
উম্মতের মাঝে থাক যে উম্মত রহমতপ্রাপ্ত
নবীজির সুন্নাতে অবহেলা নয়, থাক অনুগত।
পাখির যুক্তিতে জব্দ শিকারি আবার বলল, হদিসে বৈরাগ্যকে কেন নিষেধ করা হয়েছে, তার মর্ম আমি বুঝি। বৈরাগ্য মানে জীবন থেকে পলায়ন। গুহায় পর্বতে পাথরের কাছে আশ্রয় গ্রহণ। তাই নিন্দনীয়। কিন্তু একটি কথা আমাকে বুঝিয়ে বল, সমাজের যে লোকদের নিয়ে আমাদের বসবাস, যাদের বিবেকবুদ্ধি বলতে কিছু নেই, সততার ওপর অবিচলতার চেতনা যাদের নেই, জ্ঞানীদের দৃষ্টিতে তারা তো পাথর, ঢিলাকুলুখের মতো। আজকের সমাজ তো এসব পাথর ঢিলাকুলুখে ভর্তি। তুমি কীভাবে আমাকে তাদের মাঝে বসবাস করতে পরামর্শ দাও। এরা শুধু পাথর কুলুখ নয়; গর্দভের সঙ্গে তুলনীয়।
চোন হেমার আস্ত অনকে নানাশ উমনিয়ত আস্ত
সুহবতে উ আইনে রাহবানিয়ত আস্ত
যার ধ্যানজ্ঞান রুটি-রুজি সে তো গাধার মতো
এদের সাহচর্যই তো হতে পারে বৈরাগ্যের অর্থ।
যাদের চিন্তায় রুটিরুটি ছাড়া আর কিছু নেই, পার্থিব উন্নতির ধান্ধায় যাদের দিন যায়, রাত আসে, তাদের সঙ্গে উঠাবসা, মেলামেশা সাহচর্যই তো বৈরাগ্য বরণ এবং তা গর্হিত ও পরিত্যাজ্য। অতএব, সংসার ছেড়ে বৈরাগ্য জীবন যেমন নবীজির সুন্নাতের বরখেলাফ বেদাত, তেমনি এই শ্রেণির দুনিয়া লোভীর সঙ্গে মাখামাখিও ইসলামের পরিপন্থি গর্হিত কাজ।
দুনিয়ালোভীরা আসলে পাথর কুলুখের চেয়েও নিকৃষ্ট। কারণ পাথর কুলুখ এ পর্র্যন্ত কোনো মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে নজির নেই। অথচ দুনিয়া পূজারীরা মানুষকে বিপথগামী করার উদাহরণ অহরহ। তাই আমার এভাবে সংসার জীবন ছেড়ে বৈরাগ্য সাধন। আল্লাহর রাস্তায় মেহনতের চিল্লাকুশি করি। এটিই আমার রেয়াজত, কৃচ্ছ্রতার পথ, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ, তাকওয়ার বাংকার।
শিকারির জবাবে পাখি বলে, তুমি যে রিয়াজত, কৃচ্ছ্রসাধনা, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলছ, তার মানে লড়াই। এই লড়াই হবে শয়তান ও শয়তানি কুমন্ত্রণার বিরুদ্ধে, সমাজের শয়তান চরিত্রের লোকদের প্রতিরোধে। শয়তান ও শয়তানি কুমন্ত্রণা যদি না থাকে, মন্দদের উৎপাতে জীবন যদি দুর্বিষহ না হয় তাহলে জিহাদ করবে কিসের বিরুদ্ধে। সমাজের অসঙ্গতি, নানা প্রলোভন না থাকলে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের মানে কী হবে? সমাজটা শয়তানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে যদি বল, আমি নির্জন নিরালায় তাকওয়ার জীবন নিয়ে আছি, বৈরাগ্য সাধনেই আমার মুক্তি, তাহলে কি তুমি মুক্তি পাবে, তা কি মুত্তাকির জীবন হবে? মুত্তাকি হতে হলে শয়তানের পাতানো জাল ছিন্ন করে তাকওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। নিজের ও সমাজের সম্মান রক্ষা, স্বজাতিকে সাহায্য করা আর অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে বীরত্বের প্রমাণ দিতে হবে।
আমাদের ধর্মের বৈশিষ্ট্য ও কল্যাণের দাবি হচ্ছে জিহাদ, সংগ্রাম, শক্তিমত্তা অর্জন। আর ইসা (আ.)-এর ধর্মের বৈশিষ্ট্য গুহায় পর্বতে গিয়ে নীরব সাধনা। শিকারি বলল, পাখি তোমার কথা সত্য বুঝলাম, তবে শর্ত হলো জিহাদে জয়ের জন্য তো মানুষের সাহায্য পেতে হবে, নিজেরও শক্তি থাকতে হবে। আমাকে সাহায্য করার লোক তো সমাজে নেই। আমার নিজেরও শক্তি নেই। এই অবস্থায় যুদ্ধ এড়িয়ে নীরব সাধনাই তো উত্তম পথ। নচেত তা ‘তাকলিফ মা লা ইউতাক’ এর নামান্তর হবে। তার মানে ‘যা বহনের শক্তি নাই তা চাপিয়ে দেওয়া’ তো জায়েজ নেই।
পাখি জবাব দেয়, শক্তি থাকা না থাকার দোহাই তোমার বাহানা, অজুহাত মাত্র। আসল ব্যাপার নিষ্ঠা ও মনের সততা। তোমার মুখের ভাষা আর অন্তরের কথা যদি এক হয় অবশ্যই তুমি সাহায্যকারী বন্ধু পেয়ে যাবে। তখন শক্তিও আপনা আপনি যোগাড় হবে। এখন তোমার কর্তব্য-
এয়ার শো তা এয়ার বিনি বি আদাদ
জাংকে বি এয়ারান বেমানি বি মদদ
বন্ধু হও মানুষের তাহলে পাবে বন্ধু শতশত
যদি বন্ধু না পাও হবে দুর্বল সাহায্যবঞ্চিত।
তুমি মনের নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে মানুষের বন্ধু হও, তাহলে তোমার বন্ধুর অভাব হবে না। বন্ধু পেলে তোমার শক্তিও হবে। কাজেই কোনো অবস্থাতেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, বন্ধুহীন থাকার চেষ্টা করো না। শয়তান নেকড়ের মতো আর তুমি ইউসুফের মতো। পিতা ইয়াকুবের হাত ছেড়ে কোথাও যেও না।
ইউসুফ (আ.)-এর সৎভাইয়েরা খেলার সাথি বানানোর কথা বলে ইউসুফকে নিয়ে গিয়েছিল পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর কাছ থেকে। তারপর পরিত্যক্ত কূপে নিক্ষেপ করে পিতার কাছে মিথ্যা জবানবন্দি দিয়ে বলেছিল, ইউসুফকে নেকড়ে খেয়েছে। বর্তমান সমাজেও একজন ইয়াকুব তোমার অভিভাবক না হলে শয়তানরূপি নেকড়ে তোমার জীবনকে ধ্বংসে তলিয়ে নেবে। তাই একজন পথ দেখানো মুর্শিদের দরকার। হাদিসে আছে, তুমি কখনও জমাতবদ্ধ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কেননা, যে ভেড়া পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তাকে নেকড়ের আক্রমণে জীবন দিতে হয়। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের দল ত্যাগ করলে তোমাকেও নেকড়ের থাবায় বিক্ষত হয়ে জীবন দিতে হবে।
অনকে সুন্নাত বা জামাআত তর্ক কর্দ
দর চুনিন মাসবানা খোনে খিশ খোর্দ
আহলে সুন্নত ও জামাত ছেড়ে যে বিচ্ছিন্ন হল
সে তো হিংস্র বনে নিজের খুন নিজেই ঝরাল।
ইসলামের নির্দেশ, তোমার জীবন সাজাতে হবে নবীজির সুন্নতের আলোতে। শর্ত হলো, সেই বিধান পালন করতে হবে সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে। এটিই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অনুসারী হওয়ার তাৎপর্য। সুন্নতের উদাহরণ রাস্তা আর জামাত বা সংঘদ্ধতা পথচলার সাথি। জীবনপথে চলতে তোমার সঠিক পথ ও সথি উভয়ের প্রয়োজন। হিংস্র জন্তুর বিচরণভূমির মতো আজকের সমাজে তুমি একলা চললে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, কোথাও মসজিদে, খানকায়, চিল্লায় কিংবা বিজন বনে নির্জন সাধনায় বসে গেলে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতকে ত্যাগ করার শামিল হবে। কাজেই সাবধান! বন্ধু মহল ছেড়ে নির্জনে যেতে নেই। তবে বন্ধুর সাহচর্যের ক্ষেত্রে শর্ত হলো-
হামরাহি না কু বুয়াদ খাসমে খেরাদ
ফুরসতি জুয়াদ কে জামেয় তো দরদ
এমন বন্ধু নয়, যে জ্ঞানবুদ্ধির দুশমন হবে
যে সুযোগ খোঁজে তোমার জামা কেড়ে নিতে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত-৪৭৮-৫০৪)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)